আড়ালে আবডালে - Bangla Romantic Horror Story


আলো ছায়ার খেলা । সন্ধ্যার আকাশে ব্যাস্ত মেঘের লুকোচুরি, আর দুষ্টু চাঁদের উঁকিঝুঁকি বিষন্ন মনেও আশার সঞ্চার করে।রিজু আর রিতু দুজনে নদীর পাশে বসে জোছনা দেখছে, আর অনুতপ্ত দুটি হৃদয় বারবারই হাতড়ে চলেছে অতীতের মধুর ভালবাসার স্মৃতি।আজ এই নির্জনে পাশাপাশি বসে থাকলেও মানসিকভাবে যেন তারা অনেক দূরে। নিরব নিশ্চল হৃদয়ে তবু পিছুটানের হাতছানি। দক্ষিণা হাওয়ার পাল উষ্ণ মনকে জুড়িয়ে বিদায় নিচ্ছে।কিন্তু ওরা চুপচাপ বসে আছে। হয়তো প্রকৃতি দেখছে মন ভরে।


রিজুর সবচেয়ে কাছের বন্ধু বাবিন দূরে একটা গাছের নীচে একলা বসে আছে।হয়তো সে নদীর ঢেউ গোনার বৃথা চেষ্টায় ব্যাস্ত।নাকি মনের গোপন ডায়েরিতে আত্মজীবনী লিখতে লিখতে ক্লান্ত হৃদয়।হবে হয়তো।তাই তো মাঝে মাঝে নিজের অজান্তেই পাগলের মত হাসছে বাবিন।আর এই গভীর নির্জনতার মাঝে তার হাসি বারবারই প্রতিধ্বন্নিত হয়ে তাকেই উপহাস করে চলেছে। একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়ল রিজু।যেন বুকের ভেতরের ব্যাথা ,বেদনা, কষ্ট সবকিছুরই প্রকাশ ঘটল।অবশেষে রিতু নীরবতা ভেঙে বলল----


--কি হল তোমার?(একটা গভীর আন্তরিকতার ছোঁয়ায় বেজে উঠল তার স্বর)


--উম। না, কিছু না।


--তাহলে কথা বলছ না যে?


রিজু কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকে । উত্তর খোঁজার বৃথা চেষ্টায় হাতড়ে যায় মনের আনাচেকানাচে। আনমনেই জবাব দেয় সে ---


--ভয়ে,যদি আবার হারিয়ে ফেলি।


রিতুর মনে রিজুর কথায় একটা অজানা আলোড়নের সৃষ্টি হল। তার কানে রিজুর কথাগুলো কয়েক সেকেন্ড ধরে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল।কোনও এক অদৃশ্য আকর্ষণে রিতু তার মনের সমস্ত ভালবাসা দিয়ে রিজুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠল।


-- আমি আর হারাব না, রিজু। তোমার কাছেই থাকব সারাজীবন।


রিজু কিছুই বলল না। মনের অতলে গোপন বেদনা চেপে রেখে , আলতো করে জড়িয়ে নিল রিতুকে। রিতুর চোখের গরম জলে রিজু জামা ভিজতে শুরু করল। আর অদৃশ্যে অগোচরে অভিন্ন দুই গোপন উষ্ণতার মিলন ঘটল । রিতু অধোস্বরে বলল--


--তুমি বোঝ না , আমি তোমাকে ছাড়া একমুহূর্ত থাকতে পারি না ,তাহলে আমাকে এতদিন কষ্ট দিলে কেন?


-- রিতু আমি সেদিন তোমাকে বোঝানোর অনেক চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু তুমি, আমার কোনও কথা বোঝার চেষ্টাই করনি।


--সরি।( কাঁদতে লাগল রিতু)


--নিরুত্তর(শুধু একটা বেদনাদায়ক দীর্ঘনিশ্বাস মনের অজান্তেই বেরিয়ে এল)


--সেদিন আমাকে একটা থাপ্পড় মেরে বোঝাতে পারতে। কেন মারনি সেদিন আমাকে?


--ভালবাসলে তাকে যে মারতে নেই রিতু।তাকে তো হৃদয়ের গভীরে যত্ন করে আগলে রাখতে হয়।


--নিরুত্তর(রিজুর বুকে মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগল রিতু)


-- রিতু প্লিজ আর কেঁদো না। তুমি কাঁদলে আমি সইতে পারি না।


--তুমি আমাকে এতটা ভালবাস, আমি বুঝতে পারি নি রিজু।আমাকে ক্ষমা করে দাও।


--তোমাকে তো আমি সেই তিন বছর আগেই ক্ষমা করে দিয়েছি রিতু। আর তাছাড়া একজন নারী হিসেবে তোমার সেদিনের সিদ্ধান্তে তো কোনও ভূল ছিল না।কেন শুধু শুধু একটা বেকার ছেলেকে নিজের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে রাখবে?(আনমনে বলে চলেছে রিজু)সত্যি বলতে কি আমার খুব রাগ হচ্ছিল তখন। কিন্তু পরে ঠান্ডা মাথায় তোমার দিক থেকে ভেবে দেখলাম , তুমি যেটা করেছিলে ভূল করনি বরং ঠিকই করেছিলে।


কাঁদতে কাঁদতে রিতুর দুচোখ ফুলে উঠেছে। সেটা এই অস্পষ্ট জোছনার মাঝেও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।বেখেয়ালে বলা রিজুর এই কথাগুলোতে রিতু যে আরও কষ্ট পাচ্ছে , আর সেই কষ্টের বহিঃপ্রকাশ তার কান্নায় ফুটে উঠেছে।


--রিজূ ক্ষণিকের মোহতে আমি তোমাকে চিনতে ভূল করেছিলাম। আমি তোমাকে খুব ভালবাসি রিজু।


--এই পাগলী আমি কি তোমাকে ছাড়া অন্য কাউকে ভাসবাসতে পারব ? তাইতো অপেক্ষায় ছিলাম। আর বাবিন হতচ্ছাড়াটার জন্য অপেক্ষার সময়টা সংক্ষিপ্ত হয়ে গেল।


--জান রিজু, সেদিন তোমাকে ওই কথাগুলো বলার পর কোনও রাতেই ভালভাবে ঘুমোতে পারিনি।একটা চাঁপা বেদনা হৃদয়কে বিষিয়ে দিয়েছে।শুধুই ভেবেছি ।মনের কাছে প্রশ্ন করেছি , কিন্তু কোনও উত্তর পাইনি।একাকী সময়ের নীরবতাও আমার সঙ্গে ঠাট্টা করেছে।(আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছতে গিয়েই মুখে আঁচলচাঁপা দিয়েই কাঁদতে শুরু করল)


--এই সাপ(আচমকাই বলে উঠল রিজু)


রিতু সহজাত কারনেই একটা ভিতু চিৎকার করে রিজুকে জড়িয়ে ধরল।


--প্লিজ, ওকে তাড়িয়ে দাও।


-- হা-হা-হা। মজা করছিলাম।


--উম।(কপট রাগ প্রকাশ)তোমাকে আমি------।(রিতু , রিজুর বুকের ওপর আলতো করাঘাত করতে লাগল)


--এই ।রিতু, এই, না, না , হা, হা, হা এই।(রিজু কিছুটা সামলানোর ভঙ্গি করলেও মন খুশিতে ভরে উঠল)


রিতু হঠাৎ করেই থেমে গেল । তার ঠোঁটের কোনে এক চিলতে তৃপ্তির হাসি জড়িয়ে আছে।দু হাত দিয়ে মুখের ওপরের এলোমেলো চুলগুলো সুন্দর করে কানের পাশে টেনে সরিয়ে দিল।মিষ্টি চাঁদের আলোয় নদীর জলের ঝিকিমিকি আর ব্যাস্ত বাতাসের শীতল শিরশিরানিতে রিতুর মনটা ফুরফুরে হলেও, বাবিনের বিষন্ন হাসিতে মনের কোনে গোপন ব্যাথা দোলা দিয়ে গেল। রিতু নিজেকে সামলে নিয়ে বলল--


-- আচ্ছা , বাবিনকে একবার ডাকবে?


-- কেন?


-- ও কে থ্যাঙ্কস বলব।


-- ও আচ্ছা।


-- আচ্ছা , ও ওইভাবে হাসছে কেন?


-- হুম। (হাসল রিজু) হাসছে না। মনের মাঝে সুদূর অতীতের জ্বালা আগুন নেভানোর চেষ্টা করছে।


-- মানে ?


পুরোনো দিনের অস্পষ্ট ইতিহাস আর বাবিনের সেই করুন মুখটা ভেসে উঠল মনের পর্দায়।চোখের কোনে উষ্ণতার ছোঁয়া লাগল। হাত দিয়ে চোখের জলটা মুছল রিজু । খানিকটা ভেজা স্বরে রিজু বলল---


--ওর কথা শুনে আর কি করবে? ও ওরকমই। কেউ কষ্টে আছে দেখলে , ও তাকে খুশি করার চেষ্টা করে। অথচ ওর নিজের মনেই কত কষ্ট জমে আছে।নিজের অনুভূতিগুলোকে ও প্রকাশ্যে আনতে চায় না।সব অনুভূতিগুলো ও প্রকৃতির সঙ্গে ভাগ করে নেয় এভাবেই।


--তুমি কিছু করতে পার না ওর জন্যে?(কিছুটা অনুরোধ জড়িত কন্ঠে কথাটা বলল রিতু)


-- জান, সারাজীবন আমার ঐ একটাই আফসোস রয়ে যাবে। আমার সামনে ------- নাঃ।আসলে আমার হাত পা ওই বেধে রেখেছে।


-- আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না । তুমি ও কে একবার এখানে ডাকবে প্লিজ।


--কেন? ওর প্রেমে পড়লে নাকি আবার?


রিতু ছোট্ট প্রেমাঘাত করে , মুখে কপট রাগের ভান করে। আর জোছনায় ঢাকা প্রকৃতির মাঝে রিতুর রাগভর্তি মুখটা আরও সুন্দর মোহনীয় হয়ে ওঠে। রিজু ডাক দেয় বাবিনকে। বাবিনের হাসি থেমে যায়।দূরে কোথাও জলের ছলছল শব্দ পাওয়া যায়। ধীরে ধীরে আবার নিস্তব্ধ হয়ে যায় প্রকৃতি।রূপোলি চাঁদ মেঘে ঢেকে যায়, আবার মেঘের আড়াল থেকে চাঁদ উঁকি দেয়।


একটা কালো মূর্তি অন্ধকার কেটে এগিয়ে আসতে থাকে ওদের দিকে । ধীরে ধীরে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয় সেই মূর্তি।সেই আলোআঁধারিতে চঞ্চলা রিতুর মনে হয়, যেন সাক্ষাৎ কোনও দেবতা এসে দাঁড়িয়েছে তার সামনে। এ ভালোবাসার দেবতা, প্রেমের দেবতা।যে নিজের শত কষ্ট বুকে চেপে , অন্যের মুখে একফোঁটা হাসি ফোটাতে এগিয়ে আসে। ঠাকুর ! তোমার শ্রীপাদপদ্মে শতকোটিতম প্রণাম।


-- তোর রুমালটা দে তো রিজু।আমারটা কোথায় উড়ে গেল আর খুঁজেই পেলাম না।( উত্তাপ মেশানো কন্ঠস্বর)


রিজু তার রুমালটা এগিয়ে দিল বাবিনের দিকে।


-- মিথ্যে বলছিস? আজ আবার কাঁদছিলি?


-- নারে , চোখটা যেন হঠাৎ ঝাপসা হয়ে এল।তাই চোখে জল দিয়ে এলাম।( প্রসঙ্গ পরিবর্তন করল বাবিন)তোরা কি এখনই বাড়ি যাবি?


--না , দেরি আছে।


-- তাহলে আমাকে এখন ডাকলি কেন?


-- রিতু তোকে ডাকতে বলল।


-- ও আচ্ছা।কি মেমসাহেব! রাগ-টাগ কমল তো?আর তাছাড়া রেগে আর কি হবে বলো? যত রাগবে , বুঝবে তুমি ততই লস করছ।


রিতু মুগ্ধ হয়ে শুনছিল দুই বন্ধুর নাটকীয় কথোপকথন। কত রাগ, ঝগড়া, অভিযোগ, অভিমান সবই ভালবাসায় মিলিয়ে যায়।এটাই বন্ধুত্ব , এটাই বন্ধন।


-- হুম । তুমি ঠিকই বলেছ বাবিন। আচ্ছা আমাদের কথা তো অনেক হল। কিন্তু তোমার কথা তো একবারও বললে না।


-- আমার আর কি কথা মেমসাহেব? আমার সব কথা এই খোলা আকাশে নির্মল হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়েছি।আর যেটুকু জমা ছিল সেটুকুও আর বেঁচে নেই বুঝলে, সময়ের ব্যবধানে দমবন্ধ হয়ে মারা গেছে।


-- মানে?


-- হুম---।(হাসল বাবিন)সব মানের উত্তর হয়না মেমসাহেব। বাস্তব বড়ো কঠিন। আর তাকেই আজ ভালবেসেছি। ঐ যে কবিগুরু লিখে গেছেন না----


"কঠিনেরে ভালবাসিলাম


সে কখনও করে না বঞ্চনা।"


বাস্তব কখনও আমাকে ঠকায় না।


-- বাস্তবকে তো আজ ভালবেসেছো , কিন্তু তোমার অতীত?


-- অতীত! হা হা হা হা ( উচ্চৈস্বরো হাসল বাবিন)মেমসাহেব । আমার অতীতের ভালবাসা ঐ সহস্র নুড়ির মাঝে হারিয়ে যাওয়া হিরের মত , বুঝলে? হাজার খুঁজলেও আর পাওয়ার আশা নেই।


-- বাবিন । সহস্র নুড়ির মাঝে হিরে হারালেও, ধৈর্যশীল ব্যক্তি নিশ্চয়ই সেটা খুঁজে বের করে। আমার মনে হয় তুমি তোমার হারানো ভালবাসা একদিন না একদিন খুঁজে পাবেই পাবে ।


-- মেমসাহেব ওসব সিনেমার পর্দায় সম্ভব। আর তাছাড়া তোমার কি মনে হয় , ও বিয়ে না করে বসে থাকবে আমার জন্য?


-- অসম্ভব নয় তো?


-- হ্যাঁ মেমসাহেব অসম্ভবই। কারন আজই ওর বিয়ে।


রিজু এবং রিতুর প্রতিটা শিরা উপশিরায় এত দ্রুত একটা শিহরণ বয়ে গেল যেন ওরা দুজন সোজা হয়ে বসল।


--তো , তুমি এখনও এখানে বসে আছ?


-- তো কি করব মেমসাহেব? গিয়ে বলব, আমি তোমাকে ভালবাসি। ওকে বিয়ে কর না , আমাকে বিয়ে করলে সুখি হবে।


-- এটাও বলতে পারতে যে যাকে তুমি বিয়ে করছ তাকে কি তুমি সত্যিই ভালবাসো?


-- কি অধিকার আছে মেমসাহেব?


-- কেন ?তোমার ভালবাসার অধিকার।


-- সেই অধিকারও আমার কাছ থেকে হারিয়ে গেছে মেমসাহেব।


--মানে?


--মেমসাহেব এসব কথা ছাড়ো।আজ হয়তো আমার ভালবাসার সমাধি হয়েছে , কিন্তু তোমাদের পুরোনো ভালবাসাকে মিলিয়েছি এটাই আমার বড় প্রাপ্তি।


আবার নিস্তব্ধ পরিবেশ। উজ্জ্বল জোছনায় নদীর জল চিকচিক করছে। মৃদু শীতল হাওয়ার পরশ অপূর্ব সুখানুভুতি সৃষ্টি করছে মনে। আর এই নদীর মতোই সবার জীবন নদীও বয়ে চলেছে আড়ালে আবডালে কুলুকুলু সুরে । দুর্দমনীয় স্রোতের টানে কখনও একুল ভাঙে ওকুল গড়ে।আবার বেখেয়ালি স্রোত তার নিজস্ব গতিতে এগিয়ে চলে জীবন বৈচিত্রের খোঁজে।নিরবতা ভেঙ্গে রিজু বলল--


-- অনেক রাত হল। চল যাওয়া যাক।


-- হ্যাঁ সেটাই ভাল । চল। (রিতু বলল)


ওরা তিনজন এই শান্ত নির্জন নদীর পাড় ছেড়ে যার যার গন্তব্যে রওনা দিল।


কয়েকটা দিন অনায়াসেই কেটে গেল। রিজু রিতুর আর কোনও খোঁজখবর বাবিন রাখে না । কারন, বাবিনের দৃড় বিশ্বাস ওরা ভাল আছে, আর ভবিষ্যতেও ভাল থাকবে।আর তাছাড়া ওদের এই পূনর্মিলনের আনন্দঘন মুহুর্তে , ওদেরকে আর ডিসটার্ব করতে মন চায় না বাবিনের।এখন সে একেলা নির্জনে পূর্বের অপ্রত্যাশিত পরিবেশের অলসসম দূঃখকে বিসর্জন দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু আদৌ কি সেটা সম্ভব? কোনও কারনে একবার যদি কোথাও ক্ষত তৈরি হয়, সহজে কি সেই ক্ষত নিরাময় সম্ভব? আর যদিও শুকায় তার স্মৃতিস্বরুপ একটা দাগ রয়ে যায় আজীবনের জন্য। যেটা একাকী উদাস সময়ে তীলে তীলে ধ্বংস করে দেয় সুন্দর সুস্থ মানসিকতা। হয়তো এর থেকে নিস্তার নেই । বাকিটা জীবন হয়তো এভাবেই কাটাতে হবে , নিরালায় আত্মগোপন করে।


সূয্যিমামা বিদায় জানিয়ে চলে গেছে বহুক্ষণ আগে।ধীরে ধীরে রাত্রির অন্ধকার গ্রাস করছে নিস্তব্ধ পাড়ার সুনসান গলি।প্রতিবেশীদের বাড়ী থেকে উলুধ্বনি ভেসে আসছে।তুলসী তলার সন্ধ্যাপ্রদীপ দক্ষিনা হাওয়ায় নিভু নিভু করছে। এই শান্ত মনোরম পরিবেশেও বাবিনের মন ভালো নেই। তাই সে অনেকদিন পর রাস্তা দিয়ে ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে চলছে উদ্দেশ্যহীন ভাবে।জনবসতি ছেড়ে বাবিন এগিয়ে চলল তার চিরপরিচিত ছেলেবেলার সুখদুঃখের সাথী নদীর দিকে।


নদীপাড়ের সেই বুড়ো বটগাছের নিচে ঠেস দিয়ে বসে ভাবনার জগতে ডুবে গেল। সেই ভাবনা চিন্তার ঢেউ পরস্পর ধাক্কা খেয়ে পাড়ে গিয়ে মিলিত হচ্ছে। কিন্তু কোনও প্রতি উত্তর ফিরে আসছে না।শীতল হাওয়ার দল বাবিনের ঝাঁকড়া চুলের ফাঁক দিয়ে উষ্ণতা নিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে কোন অজানায়, কে জানে?চিন্তার জট বাড়ছে । ভাবছে , শুধুই ভাবছে।তার ভাবনার রাজ্যে বিরাজ করে আছে সুচরিতা। তার কৈশরের গভীর প্রনয়, আজও মনের ফ্রেমে বন্দি হয়ে আছে। তবুও, আজ সুচরিতাকে বাবিনের ভুলতেই হবে। তা না হলে যে বাবিন সমাজের চোখে হবে পরনারীগামী। কিন্তু সুচরিতা ! সেও কি তবে ভুলে গেছে তাকে চিরজীবনের জন্য?


নদীর জলের ঢেউ আর বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ ছাড়া এই নির্জনে দ্বিতীয় কোনও শব্দ নেই। না না আছে, বাবিনের বেদনাসিক্ত হৃদয়ের শব্দ আছে, আর থাকলেই বা কি আসে যায়, ওটা তো স্বাভাবিকভাবে শ্রবনসিদ্ধ নয়। আনমনে নদীর জলে ঢিল ছুড়তে লাগল বাবিন, আর তার মস্তিষ্ক মরা আর বাঁচার মধ্যেকার ব্যবধান পরিমাপে ব্যাস্ত হয়ে পড়ল। হাওয়ার গতি ক্রমশ কমছে। আলোছায়ার খেলা আর চলছে না। ক্লান্ত চাঁদ মেঘের আড়ালে বিশ্রাম নিচ্ছে। এই থমথমে পরিবেশের নিশ্চুপ নিরবতা ভঙ্গ করে একটা পাখি হঠাৎ কিচকিচ করে ডাকতে ডাকতে গাছ থেকে উড়ে পালাল। এই ক্ষণিকের বিঘ্নতায় বাবিনের অন্যমনস্কতা কিছুটা কেটে গেল।


আকাশের দিকে তাকাল বাবিন।মেঘ ঘনিয়ে আসছে। সেই কালো মেঘের ঘেরাটোপে দুষ্টু চাঁদও পথ হারিয়েছে। প্রকৃতি থেকে জোছনার রেখা ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে। ভালবাসাও বোধহয় আলোছায়ার মতোই একটা খেলা।


একটা দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করল বাবিন। মৃদু শীতল হাওয়ার পরশে বাবিনের মনের উষ্ণতার পারদ ধীরে ধীরে নামতে শুরু করেছে। ঠিক সেই মুহুর্তে বাবিনের মনে হল , কোথাও যেন কেউ কাঁদছে।কিন্তু কোথায়? ভাল করে শোনার চেষ্টা করল বাবিন। নাঃ, কিছুই শোনা যাচ্ছে না আর।হয়তো তার মনের ভূল। একটা ঢিল হাতে নিয়ে ঠিক মাঝ নদীতে ছুড়তে যাবে , এমন সময় আবার সেই কান্নাভেজা শব্দটা ভেসে এল। এবার সেই কন্ঠস্বর খানিকটা স্পষ্টই শোনা গেল।বাবিন কান পেতে শুনল এবার। না , এটা তার মনের ভুল নয় । শব্দটা আসছে পশ্চিম দিক থেকে। বাবিনের মনে প্রশ্ন দেখা দিল। এত রাতে, এই নির্জনে একজন মহিলা কাঁদছে কেন? বাবিন কৌতুহল দমন করতে এগিয়ে চলল উৎসের দিকে। ধীরে ধীরে কান্নার শব্দ আরও স্পষ্ট হতে লাগল। ।হাতের অবশিষ্ট ঢিল গুলো নদীতে ছুড়ে দিয়ে এগিয়ে চলল বাবিন।


শ্মশানের দিক থেকে ভেসে আসছে সেই নারীকণ্ঠের অস্পষ্ট করুণ কান্নার সুর। সে সুর অতি কোমল, মধুর, বিষাদময়।এক অজানা আকর্ষণে এগিয়ে চলল বাবিন। এই আবছা অন্ধকার রাতে শ্মশান থেকে করুণ কন্ঠের অস্পষ্ট কান্নার সুর ভেসে আসছে এটা উপলব্ধি করেই বাবিনের হৃদয়ে ধুকপুক ধুকপুক করে মৃদু কম্পন শুরু হল।বাবিন শ্মশানে কাছাকাছি আসামাত্রই কান্নার সুর থেমে গেল।সাহসে ভর করে এগিয়ে চলল সে। কিন্তু একি! শ্মশান যে ফাঁকা । কেউ তো নেই এখানে। বাবিনের হৃদয় ছ্যাত করে উঠল। তাহলে করুণ কন্ঠের সেই কান্নার কন্ঠস্বর কার?


ভয়ে তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছে।তবুও এই ভয়কে পাত্তা না দিয়ে এগিয়ে চলল। ধীরে ধীরে শ্মশানের উপর উঠল। নাঃ, কেউ নেই। হঠাৎ আবার কান্না শুরু হল । একনাগাড়ে কান্না চলছে তো চলছেই। এবার উপলব্ধি করল বাবিন , আসলে কান্নাটা আসছে শ্মশানের ওপাশের শিরীষ গাছের নিচ থেকে। একটা অজানা কৌতুহলে এগিয়ে চলল বাবিন। আবছা জোছনায় বাবিন স্পষ্টভাবে কিছুই দেখতে পেল না ।


তবে বাবিনের যেন মনে হল শিরীষ গাছটার একটা মোটা শেকড়ের ওপর একটা মেয়ে মাথা নিচু করে বসে বসে কাঁদছে।কোনওমতেই মেয়েটাকে ঠিক চিনে উঠতে পারল না বাবিন। অবশেষে অতি সন্তর্পণে তার কাছে এগিয়ে গেল।


-- এই যে শুনছেন?(নিজের কন্ঠস্বরে নিজেই চমকে উঠল বাবিন)


এ কার কন্ঠস্বর? এ তো তার কন্ঠস্বর নয়। তবে কি বাবিন ভয় পেয়েছে? ভয়ে আর বিস্ময়েই কি তাহলে তার এই স্বাভাবিক কন্ঠস্বরের পরিবর্তন হয়েছে? আচ্ছা, সে স্বপ্ন দেখছে না তো? নিজের হাতেই একটা চিমটি কাটল সে। নাঃ, স্বপ্নের সম্ভাবনাই নেই । চিমটি কাটলে রীতিমতো লাগছে। তাহলে? এতগুলো অস্তিত্বহীন জটিল প্রশ্নে বাবিনের মাথাটা ঘুলিয়ে গেল। এমন সময় অস্পষ্ট কান্নাভেজা কন্ঠে জবাব এল-


-- হ্যাঁ। --- বলুন।


-- আপনি এত রা---ত্রে, এ--খা--নে বসে কাঁদছেন কে----ন?(খানিকটা তোতলাতে তোতলাতে বলল)


-- না, কিছু হয়নি।(স্বর অস্পষ্ট)


-- তাহলে কাঁদছেন কেন?( অতি দ্রুত বলল বাবিন)


-- ভাল লাগছে তাই কাঁদছি। আপনি কে এসব কথা বলার? ( কাঁদতে কাঁদতেই বলল)


মেয়েটির কথা শুনে বাবিনের মনে হল এটা মেয়েটির আসল কন্ঠস্বর নয়। কেমন যেন একটা ভাঙা ভাঙা কন্ঠস্বরে কথা বলছে মেয়েটি। ভয়টা আরও প্রখর ভাবে মনের অন্দরে বাসা বাধতে লাগল। বাবিন থতোমতো খেয়ে বলল


--আমি কে? কে আমি? ( আনমনে) ও হ্যাঁ, মানুষ মানুষ। কোনও সন্দেহ নেই। ত--বে। আ-প--নি কি মানুষ?(ভয়ে তার পা কাঁপতে লাগল)


-- কেন ? আমাকে কি অন্য কিছু বলে মনে হচ্ছে?(খানিকটা কান্নাজড়িত নাকি কন্ঠস্বরে বলল)


-- না - - - -, মানে পে - - - ত্নী।( মনে হল মেয়েটা যেন মাথা তোলার চেষ্টা করছে। বাবিন প্রসঙ্গ পরিবর্তন করল) আসতে পারে । হে হে হে( কৃত্রিম হাসি) । আসতে পারে । আপনি একা এত রাতে শ্মশানের পাশে বসে কাঁদছেন তো । কত ভয়ের ব্যাপার আছে বলুন তো?


-- কান্না চলছে।


-- আপনার পাশের ওই লম্বা শেকড়টায় একটু বসব?( ধুর ছাই গলার কন্ঠস্বর কোনওমতেই বাগে আসছে না)


-- মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জ্ঞাপন করল মেয়েটি।


বাবিন ধীরে ধীরে শেকড়ের ওপর গিয়ে বসল।ভয়ে বুক দুরুুদুরু করছে তার। কতটা ভয় পেলে গলার কন্ঠস্বরের পরিবর্তন ঘটে । আর তার পাশে বসে থাকা মেয়েটা কে? এই জটিল হিসেব কোনওমতেই মেলাতে পারছিল না বাবিন। অবশেষে সে একটা সিদ্ধান্তে এল যে বাবিনের পাশে বসে থাকা মেয়েটি কোনও মেয়ে নয় একটা জলজ্যান্ত পেত্নি। আর এটা ভেবেই বাবিন শিউরে উঠল যে সে একটা পেত্নির পাশে এতক্ষণ বসে আছে। তার হাতের লোমগুলো পর্যন্ত ভয়ে দাঁড়িয়ে গেছে।আবার এটা চিন্তা করে সে মনটাকে কিছুটা সান্ত্বনা দিল যে এটা কাঁদুনে পেত্নি হয়তো অতো ভয়ের কিছুই নেই।


-- আপনি এখানে কেন এসেছেন? চলে যান। আমি মরতে চাই।( সেই কান্নাভেজা ভাঙা গলায় অস্পষ্ট জবাব)


বাবিন কিঞ্চিত সাহস সঞ্চয় করে একটা হাই তুলল। যদিও হাই তোলার সেই মুহূর্তের শব্দটা পর্যন্ত অস্বাভাবিক শোনাল।অবশেষে মনে আরও কিছুটা সাহস সঞ্চয় করতে একটা হাত উপরে ঘোরাল।কিন্তু এখানেও যেন আড়ষ্টতা। একটা দড়ির মতোই যেন ঠেকল হাতে। ভয়ে বিস্ময়ে উপরে তাকাল সে। সেই আবছা আলোতেও সে স্পষ্টই দেখল যে একটা দড়ির ফাঁস ঝুলে রয়েছে ঠিক তারই মাথার উপরে। বাবিনের হৃদপিন্ডটা তড়াক তড়াক করে লাফিয়ে উঠল দুবার। সে উপরে চোখ রেখেই বলল--


-- আপনি তো মরেই গেছেন।(এবার মেয়েটি সত্যিই মাথা তুলল, কিন্তু একরাশ লম্বা চুলের জন্য চেহারাটা অস্পষ্টই রয়ে গেল। ভয়ে ভয়ে ঢোক গিলে বলল) না মানে, ইয়ে। কেন? কেন, মরতে চান আপনি? কি এমন কষ্ট পেয়েছেন জীবনে?


-- হুম ( হাসার চেষ্টা করল মেয়েটি) শুনবেন?


-- না , না থাক থাক। ( মেয়েটি নড়ে চড়ে বসল যেন) বলুন বলুন। হে হে হে। শুনব।( মাথা নাড়ল বাবিন)


একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়ল মেয়েটি।যেন মনের সমস্ত কষ্ট , বেদনা নিংড়ে বেরিয়ে এল নিশ্বাসের সঙ্গে। খানিকক্ষণ প্রকৃতির নিস্তব্ধতার সঙ্গে তাল মেলাল দুজনে। আলো ছায়ার লুকোচুরি চলছে। মৃদু শীতল হাওয়া আরও শীতল আরও মধুর পরশ দিয়ে এগিয়ে চলেছে অজানা গন্তব্যে। আর বাবিন? তার মন পালাব পালাব করছে। কিন্তু মনে সাহসের ক্ষুদ্র কনাটুকুও অবশিষ্ট নেই। চাঁদের অবস্থান দেখে সে বুঝল যে সে যতটা ভেবেছিল ততটা গভীর রাত হয়নি।বাবিন আপনমনে ভাবতে লাগল , বোধহয় এই শ্মশানের পাশে অথবা এই শিরীষ গাছেই হয়তো এই অপরিচিতা নারী আত্মঘাতী হয়েছিলেন।হয়তো আজ তারই আয়োজন চলছে। কিন্তু সে কেঁদেই চলেছে। তাহলে কি সে কারও অপেক্ষায় আছে। মানে আরও ভুত পেত্নি---। নাকি বাবিনকেই চড়িয়ে দেবে। আৎকে উঠল বাবিন। জিভটা মুখের ভেতরে ঘুরিয়ে নিল সে , কিন্তু জিভের জল পর্যন্ত শুকিয়ে গেছে ভয়ে। ভাবতে লাগল বাবিন । এই নির্জনে গভীর রাত্রে কেউ তার সাহায্যের জন্য আসবে না। তাহলে , সারারাত এই পেত্নির সাথে । ভাবতেই যেন কষ্ট হচ্ছে। এখন ভাগ্যের উপর নির্ভর করা ছাড়া কোনও উপায় নেই।অবশেষে মেয়েটা অশ্রুভেজা গলায় বলতে আরম্ভ করল তার জীবনের কাহিনী।


--সেদিন ছিল বিয়ের রাত। আমার বিয়ে ছিল সেই রাতে।


বাবিন মনে মনে ভাবছিল , বোধহয় বিয়ের রাতেই মরেছিল পেত্নিটা।মেয়েটাকে চুপচাপ দেখে বাবিন উৎসাহ দিল।


-- হ্যাঁ, হ্যাঁ । তারপর।


-- আমার কোনও মত ছিল না বিয়েতে।মা বাবার মুখের দিকে তাকিয়েই বিয়ের পিড়িতে বসেছিলাম।


-- হে হে হে । সবাই তো তাই করে আর কি। মা বাবার মুখের দিকে তাকিয়েই বিয়েটা করে নেয়।


-- এত তাড়াতাড়ি বিয়েটা ঠিক হল যে যাকে ভালবাসতাম তাকে পর্যন্ত খবরটা দিতে পারলাম না। হুম,( হাসল) আর বিয়ে, সে তো তাসের ঘরের মতোই ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। বিয়ে বাড়িতে বর এল না। আর আমি হলাম লগ্নভ্রষ্টা।


-- ও, হো , হো, হো। এই ব্যাপার। ও তো এখন আর কেউ মানে টানে( মেয়েটার হাতের আঙুলগুলো নড়ে উঠল যেন, নিস্তব্ধ রাতে কোথায় যেন একটা ভৌতিক শব্দ সৃষ্টি হল, যা বাবিনের স্বল্প সঞ্চয়ী সাহস কেড়ে নিল) না না না। মানে , মানে এখনও মানে অনেকেই।


-- সেই রাত থেকে বাড়ি ছাড়লাম আমি।চলে এলাম এই গ্রামে , কারন আমার ভালবাসার মানুষের বাড়ি এই গ্রামেই। কিন্তু কপাল এতটাই খারাপ যে, অনেক খোঁজাখুঁজির পরেও তাকে খুজে পেলাম না। যেন সেও হারিয়ে গেছে তার চেনা প্রকৃতি থেকে। কি আর করা , শেষমেশ ঠিক করেছি , আজ সেই যখন নেই তখন আমার এই জীবন রেখে কি লাভ? তাই শেষবারের মত মন ভরে কাঁদছি।


বাবিন যেন আনমনে ভয়মিশ্রিত মনেই শুনে চলেছিল কথাগুলো ।যদি তার প্রেমিকা এমন হত । শেষের দিকটায় বাবিনের খেয়াল হল মেয়েটার স্বরের আড়ষ্টতা কমেছে।সেই কান্নাভেজা ভাঙা স্বর স্বাভাবিক হয়ে আসছে। যেন সেই কন্ঠস্বর কিছুটা চেনা লাগছে। চট করে খেয়াল হল মুখটা এখনও ভালকরে দেখতেই পায়নি ভয়ে । মনে পড়ল তার পকেটে দেশলাই রয়েছে। ক্ষণিকের জন্য ভয় কেটে গেল মন থেকে।কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে পকেটে দেশলাই খুঁজতে লাগল বাবিন। তবুও যেন হাত ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে আসছে। অনেক চেষ্টার পর দেশলাইয়ের একটা কাঠি বের করে আগুন জ্বালাল সে । সেই স্বল্প সময়ের ক্ষীণ আলোয় যা দেখল , তাতে তার এই বিচিত্র রাতের আলাপ স্বপ্ন বলে মনে হওয়াই স্বাভাবিক।তারই সামনে যে ক্রন্দনরতা নারী বসে আছে সে আর কেউ নয় তারই জীবনসঙ্গীনী সুচরিতা ।


-- তুমি! (আবারও চমকে উঠল সে, তার কন্ঠস্বরও ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে, হয়তো চেনা লোকের সংস্পর্শে ভয়টা কমেছে)


-- উম । কে?


-- আমি বাবিন।সুচরিতা, আমাকে চিনতে পা--র--ছ না । এই দেখ আমি এসেছি ।


-- তুমি বাবিন। আমার বাবি--------।


কিছুদিনের অনাহার আর পরিশ্রমের জন্য শরীর দূর্বল হয়ে পড়েছিল সুচরিতার। অজ্ঞান হয়ে গেল সে।


-- সুচরিতা। সু --- চ ---


বাবিন বুঝতে পারল সুচরিতার জ্ঞান নেই। সে সুচরিতাকে সর্বশক্তি দিয়ে কোলে তুলে দৌড়তে লাগল নদীর দিকে। শ্মশান থেকে নদী অনেকটাই দূরে। হঠাৎ হোঁচট খেল বাবিন। কিন্তু সামলে নিল সে। একটা চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করল ডানপায়ের বুড়ো আঙুলে।কিন্তু এখন ওসব চিন্তা করার সময় নেই বাবিনের। দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলল সে।


নদীর তীরে এনে সুচরিতাকে আলতো করে শুইয়ে দিল সে ।সাবধানে জল এনে সুচরিতার মুখে ছিটিয়ে দিল। কিন্তু জ্ঞান ফেরার কোনও লক্ষনই নেই।অবসন্ন বাবিন সুচরিতার মাথাটাকে কোলের উপর নিয়ে বসল।সুচরিতার মুখের উপর অসংখ্য জলবিন্দুর উপর জোছনার স্পষ্ট আলোয় যেন একটা অদ্ভুত দ্যুতির প্রতিফলন ঘটছে। আকাশে এখন আর মেঘ নেই। পরিষ্কার আকাশের মধ্যগগনে চাঁদ বিরাজ করছে। উজ্জ্বল জোছনায় আলোকিত চারিদিক। মৃদুমন্দ হাওয়াতে সুচরিতার এলোচুলগুলো উড়ছে। বাবিন একদৃষ্টিতে সুচরিতার মুখের দিকে চেয়ে বসে আছে। সুচরিতার চোখের পাতা দুটো একটু নড়ে উঠল যেন। বাবিন চোখ কচলে নিল। ধীরে ধীরে সুচরিতা তার চোখ খুলল। বাবিন আলগোছে তার চুল গুলোকে সরিয়ে দিল চোখের সামনে থেকে।


-- বাবিন( কেঁদে উঠল সুচরিতা)


-- আমি তো তোমার পাশেই আছি।


-- তোমাকে আমি অনেক ভালবাসি বাবিন।


-- হুম।জানি সুচরিতা।


-- আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাব না।


-- আমিও যে তোমাকে আর কোথাও যেতে দেব না।আর কেঁদনা লক্ষীটি । প্লিজ।


সুচরিতা আচল দিয়ে সাবধানে চোখের জল মুছল। আস্তে করে উঠে বসল সে। বাবিনের কাঁধে মাথা রেখে বাবিনের হাতটাকে শক্ত করে ধরল সে।বাবিনও আলতো করে জড়িয়ে নিল সুচরিতাকে। একটা অন্যরকম আমেজে ভরে উঠল দুজনের মন। আর চিরপরিচিত নির্মল শান্ত হাওয়া সমস্ত গ্লানি মুছে দিয়ে এগিয়ে চলল নতুন পথের সন্ধানে।

Post a Comment

0 Comments