বটগাছ । Bengali short story


কলমে : অমিতাভ রায়
                   

       " কত্তা, সাবধানে নামুন। " ভুটভুটিটা পাড়ে ধাক্কা খেয়ে নড়ে উঠল। কোনরকমে নিজেকে সামলালো প্রিয়দর্শী। " শুনছি নাকি ঘাট হবে। জেলাপরিষদ টাকা দেবে।" প্রৌঢ় আবদুল মাঝি বলে। এখানে আসতে আসতেই লোকটার সঙ্গে আলাপ হয়েছে। প্রিয়দর্শী এখানকার স্কুলে পড়াতে আসছে শুনে আবদুল মাঝি খুব খুশী। এই গ্রামের স্কুলে নাকি মাস্টার টেকে না। কিছুদিন পরেই চলে যায়। " এই অজ পাড়াগাঁয়ে কে আর থাকবে বলুন?" প্রিয়দর্শীরও এখানে আসার মোটেই ইচ্ছে ছিল না। বাবা- মাও চাইছিল না। কিন্তু, এই বাজারে চাকরি ছাড়া একরকমের বিলাসিতা। আর, যার আপত্তি করার কথা- সেই বর্ণা কিন্তু খুশীই হয়েছে। বলেছে," নদীর ধারে ঘর বানিয়ে আমরা দুজনে থাকবো।" এমনভাবে বর্ণা বলছিল- যেন ও স্বপ্ন দেখছে। পাড়ে নামতেই প্রিয়দর্শী দেখল বটগাছের তলায় একটা লোক বসে একদৃষ্টিতে নদীর দিকে তাকিয়ে আছে। " কত্তা, ওকে জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। আপনি সোজা চলে যান। কিছুদূর গিয়ে দেখবেন রাস্তাটা ডানদিকে বেঁকেছে। সেদিকে একটু এগিয়ে গেলেই ইস্কুলটা পাবেন।" প্রিয়দর্শী বিস্মিত চোখে লোকটার দিকে তাকিয়ে দেখল আরেকবার৷ তারপর সামনের দিকে এগিয়ে গেল।

     স্কুলবাড়ির আদ্ধেকটা সবে হয়েছে। বাকি অংশে কাজ চলছে। হেডমাস্টার সমীরণ ঘোষ সেই কাজেরই তত্ত্বাবধান করছিলেন। ওকে দেখে হেসে বললেন," তোমার অপেক্ষাই করছিলাম। টিচার নেই- বাড়ি তৈরির কাজ চলছে। আমার উপর বড্ড ধকল পড়ে যাচ্ছে। " মোট ছজন টিচার আছে। সুতরাং, সংখ্যাটা এক বাড়লো। প্রিয়দর্শীর জন্য নদীর ধারে একটা ভাড়াবাড়ি দেখে দিয়েছেন হেডমাস্টার। স্কুলের দারোয়ান হরিপদ সেখানে পৌঁছে দিতে গেল প্রিয়দর্শীকে। হরিপদ বকবক করতে পারে বটে। " দেখুন স্যার কতদিন থাকতে পারেন! কেউ তো থাকে না বেশীদিন। " বকবক করতে করতে চলে হরিপদ।  এই স্কুল কিভাবে হল, কোথা থেকে স্কুলবিল্ডিং তৈরির টাকা পাওয়া গেল, গ্রামের লোকেরা কেমন, হেডমাস্টার আর টিচারেরা কেমন, ওর দুঃখকষ্টের সংসার কিভাবে কায়ক্লেশে চলে- এইসব বিভিন্ন বিষয়ে কথা। নদীর ধারে ওরা যখন পৌঁছল- তখনও বটগাছের তলায় লোকটা বসে আছে। শেষবিকেলের আকাশের গায়ে রঙ লেগেছে। একটু পরেই অন্ধকার হবে। একঝাঁক পাখি উড়ে গেল বাসার দিকে। লোকটার মাথাভর্তি চুল। মুখে ঘন গোঁফদাড়ির জঙ্গল। হাওয়ায় উড়ছে ওর মাথার চুল৷ লোকটার মুখে পড়ছে। তবু লোকটার ভ্রুক্ষেপ নেই। একদৃষ্টিতে নদীর দিকে তাকিয়ে আছে। " স্যার, ও পাগল হয়ে গিয়েছে। " " কেন?" " আর বলেন কেন? সে বছর পাঁচেক আগের কথা। কেষ্টর বৌ ছেলেকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিল। আর ফিরে আসেনি। যেদিন ফেরার কথা, সেদিন ঝড় উঠেছিল। নদীর জলে ডুবে যায় ওদের নৌকাটা। কেষ্টকে কেউ বিশ্বাস করাতে পারেনি সে কথা। ও আজও ঐ বটগাছের তলায় সকালসন্ধে বসে থাকে। ভাবে বৌ আর ছেলে ফিরবে৷ গ্রামের লোক দয়া করে ওকে খাবারদাবার দেয়। তাই কোনরকমে টিঁকে আছে। "  প্রিয়দর্শী লোকটার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। বলে কি হরিপদ! লোকটার মুখে শেষবিকেলের আভা পড়েছে। কিরকম করুণ লাগছে গোটা দৃশ্যটা। " চলুন স্যার, দেরী হয়ে যাবে। আমায় আবার স্কুলে ফিরতে হবে৷ " প্রিয়দর্শী এগিয়ে যেতে যেতে আবার পিছনের দিকে তাকায়। লোকটাকে ঘিরে সন্ধের অন্ধকার নেমে আসছে।

      কয়েকমাসের মধ্যেই এই গ্রামকে ভালবেসে ফেলল প্রিয়দর্শী। প্রাকৃতিক দৃশ্য অনুপম। মন ভাল হয়ে যায়। ছেলেমেয়েগুলোও খুব সরল। তবে অনেকেই দরিদ্র পরিবারের। পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়া তাদের পক্ষে খুবই কঠিন। তবুও সাধ্যমত তাদের সাহায্য করে ও। স্কুলে রবীন্দ্রজয়ন্তীও পালন করিয়েছে ছাত্রদের দিয়ে। হেডমাস্টার সমীরণ ওকে খুব পছন্দ করেন। ছাত্র- ছাত্রীরাও ওকে ভালবেসে ফেলেছে। বর্ণা আর দেরী করতে চায় না। মাকে ও বর্ণার কথা বলেই দিয়েছে।মাও চাইছে তাড়াতাড়ি বিয়ে করে ফেলুক ছেলে। একা একা এতো দূরের একটা গ্রামে থাকে। এর মধ্যে কেষ্টর সঙ্গেও ভাব হয়ে গিয়েছে প্রিয়দর্শীর। স্কুল থেকে ফেরার পথে কেষ্টর কাছে গিয়ে বসে ও। কেষ্ট মাঝেমাঝেই জিজ্ঞেস করে," বাবু একটা নৌকা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না? ওটায় বোধহয় আমার বৌ আর ছেলে আসবে। বলল তো ফিরে আসবে! এখনো আসেনা কেন?" পাড়ে আসা নৌকার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কেষ্ট। তখন খুব কষ্ট হয় প্রিয়দর্শীর। বর্ণা কেষ্টর কথা শুনে বলে," আহারে! বেচারা!" ঐ বটগাছ আর তার তলায় বসে থাকা কেষ্ট যেন চিরন্তন প্রতীক্ষার এক ছবি।

   সেদিন সন্ধেবেলায় স্কুল থেকে ফিরে মুখহাত ধুয়ে সবে বই নিয়ে বসেছিল ও৷ বাইরে ঝোড়ো হাওয়া বইছে। ঝিরঝির করে বৃষ্টিও হচ্ছে। এমন সময় প্রিয়দর্শী দেখল মাইকে কি সব ঘোষণা করতে করতে পুলিশ যাচ্ছে। ওর ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে পুলিশের বড়বাবু বলল," মাস্টারমশাই - জিনিসপত্র গুছিয়ে স্কুলে চলে যান। সাঙ্ঘাতিক ঝড় আসছে!" সঙ্গে সঙ্গে প্রিয়দর্শী সব গুছিয়ে নিয়ে স্কুলের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। গিয়ে দেখল হেডমাস্টার আর পঞ্চায়েতপ্রধান সব দেখভাল করছে। স্কুলে মাথাগোঁজার ঠাঁইও যেন নেই৷ নদীর পাড়ে যারা থাকতো - তারা সবাই চলে এসেছে। হেডমাস্টারের ঘরেই ওরা সারারাত কাটিয়ে দেবে ঠিক হল। হঠাৎ চেঁচামিচি শুনে প্রিয়দর্শী তাকিয়ে দেখে পাগল কেষ্টকে জোর করে ধরে আনা হচ্ছে। ও নাকি বটগাছতলা ছেড়ে আসতে চাইছিল না। ওর দিকে তাকিয়ে কেষ্ট বলে," বাবু, বউয়ের নৌকা যদি ডুবে যায়? তাহলে তো সব শেষ হয়ে যাবে!" প্রিয়দর্শীর গলার ভেতরে কেমন দলা পাকিয়ে উঠছে। পাগলকে ধরে একটা ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়া হল।

   ঝড় এল শেষ রাতে। কি প্রলয়ঙ্কর ঝড়! ঝড়ের এই তান্ডব প্রিয়দর্শী কখনো দেখেনি। ভয়ে শিউরে উঠছে ও। মনে হচ্ছে এই স্কুলবাড়ি যেন ভেঙে গুঁড়িয়ে যাবে। বাইরে গাছ ভেঙে পড়ার শব্দ পাচ্ছে। স্কুলের যে অংশটা নির্মীয়মান - সেটাও ভেঙে পড়ে গেল। হেডমাস্টারের মুখের দিকে তাকিয়ে কষ্ট হচ্ছে ওর। কতো কষ্ট করে টাকা জোগাড় করেছেন উনি। একদিনের ঝড়ে সব গেল। পুলিশের বড়বাবু বলল, " নদীর বাঁধ ভেঙে গেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে! সব ফসল নষ্ট হবে।" ঝড় থামার পরেও বৃষ্টি থামল না। পরের দিন সকালে বৃষ্টি ধরতে বোঝা গেল ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ঘরবাড়ি ভেঙেছে- গাছ পড়ে গেছে-ফল আর ফসল নষ্ট হয়েছে- পুকুর উপচে মাছ বেরিয়ে গিয়েছে। গ্রামের লোকের মাথায় হাত৷ দুদিন ত্রাণশিবিরেই খিচুড়ি আর চিঁড়ে খেয়ে কাটল প্রিয়দর্শীসমেত অনেক গ্রামবাসীর। দুদিন পরে বাড়ি ফেরার পথে নদীর পাড়ে গিয়ে চমকে গেল ও। এতদিনের বটগাছটা উল্টে পড়ে গেল! বটগাছের পাশে পাগল কেষ্ট বিষণ্ণ হয়ে বসে আছে। " আমার বউ আর ছেলে বোধহয় আর নেই বাবু। " কান্নায় ভেঙে পড়ে কেষ্ট। ওর দিকে তাকিয়ে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনা প্রিয়দর্শী। চোখ ঝাপসা হয়ে যায় ওর। প্রায় দৌড়ে বাড়ির দিকে এগিয়ে যায় প্রিয়দর্শী।

     স্কুল ছুটি ছিল কয়েকদিন। কিন্তু, নৌকাচলাচল পুরো বন্ধ। ফোনের নেটওয়ার্ক ফেরার পরে চিন্তিত বর্ণা আর মা ফোন করে। বর্ণা ফোন করে কেষ্টর খবরও জিজ্ঞেস করে। শুনে বলে," ঐ বটগাছ আর ওর বউ আর ছেলে বোধহয় সমার্থক হয়ে গিয়েছে ওর কাছে! বটগাছ নেই মানে, বউ- ছেলে আর ফিরবেনা। " প্রিয়দর্শী একটু অন্যরকম ভাবে। ঐ বটগাছের তলায় বসে ও প্রতীক্ষা করতো। সেই বটগাছটাই আর নেই। তাই ওর বিশ্বাসটাই ভেঙে গেছে৷ স্কুল খুলতে প্রিয়দর্শী স্কুলে যাওয়ার পথে নদীর পাড়ে গিয়ে দেখল পুরো বটগাছটাই অদৃশ্য। স্কুলে ছাত্রদের কাছে শুনল, গ্রামের কিছু লোক কেটে কেটে নিয়ে গিয়েছে বটগাছটা। খুব মন খারাপ হয়ে গেল প্রিয়দর্শীর। ফেরার পথে বটগাছটা যেখানে ছিল সেখানে ও বসল। কেষ্টকে কোথাও দেখতে পেল না। " কি কত্তা ওখানে বসে কি করছেন? " প্রিয়দর্শী তাকিয়ে দেখে আবদুল মাঝির জিজ্ঞাসু দৃষ্টি। " না, এমনিই বসে আছি। আচ্ছা- সেই কেষ্টকে দেখছি না তো?" " ও কোথায় চলে গেছে কেউ জানে না। এখন ও নাকি বুঝতে পেরেছে ওর বউ আর ছেলে আর ফিরবে না! কয়েকদিন এখানে বসে বসে কাঁদতো। তারপরে বটগাছও কেটে নিয়েছে গ্রামের লোক- আর ও চলে গেছে।" একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে আবদুল," অদেষ্ট- বুঝলেন কত্তা সবই অদেষ্ট!" পাড়ে ঢেউ ভেঙে জল ছিটিয়ে পড়ে প্রিয়দর্শীর চোখেমুখে। মুখের ভিতর ঢুকে গিয়েছে লোনা জল। কখন ঝাপসা হয়ে গিয়েছে চোখ! অস্পষ্ট হয়ে গেছে সবকিছু। অন্ধকার নামছে। উঠতে উঠতে প্রিয়দর্শী ভাবে, নদীর জল আর চোখের জল দুইই বড়ো নোনা।

Post a Comment

0 Comments