কলমে : পলাশ হালদার
১
পাগলীটা ভরত বাবুর কাছে এসে হাত জোড় করে কাঁদতে কাঁদতে বললো- "দাদা গো বৃষ্টি হলে বাচ্চা দুটোকে নিয়ে ঘরে থাকতে পারি না। ভাঙা বেড়া ভেদ করে ঝাপটা ঘরের ভিতরে ঢুকে আসে। আম্ফানে চালের খড় উড়ে গেছে। এখনো ঠিক করতে পারিনি। ওখান থেকে গলগল করে জল প'ড়ে সব ভেসে যায়। রান্নাঘরটা তো উড়ে গেছে। বৃষ্টি হলে এখন ঠিকমতো রান্না করতে পারি না, বসতে পারি না।"
- তা আমি কী করবো?
- সবাইকে এতো ত্রিপল দিচ্ছ, আমাকে একটা দাওনা দাদা। তাহলে বর্ষার মধ্যে বাচ্চা দুটোকে নিয়ে বাঁচতে পারি।
- আমি একা ক'জনকে ত্রিপল দেবো বলতে পারিস? পঞ্চায়েতে আমার বুথে মাত্র আশিটা ত্রিপল এসেছে। এতো মানুষ, সবাইকে কি দেওয়া সম্ভব!
- যাদের ছাদ ঢালাই পাকা বাড়ি তারা পেল। কোনো কোনো বাড়িতে দু'টো তিনটে করে পেল। আমার ঘরবাড়ি সব শেষ হয়ে গেছে। আমি একটা পাবো না দাদা?
- এটাই তোদের দোষ। কারো ভালো দেখতে পারিস না। এবার পাসনি তো কী হয়েছে! পরের বার পাবি।
- ততদিন এই ভাঙাচোরা ঘরে ভিজবো দাদা!
- তোর ঘরবাড়ি ভেঙেছে সেটা কি আমার দোষ? তোর বর তোকে ছেড়ে অন্যের বৌকে নিয়ে পালিয়েছে সেটাও কি আমার দোষ? সে থাকলে তো এতদিন ঘর সারিয়ে নিত।
পাগলী আর রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। লজ্জায় মাথা নীচু করে নিল। আঁচলে মুখ ঢেকে ঢুকে গেল নিজের ভাঙ্গা ঘরে। এই একটা জায়গায় সে বারবার ক্ষত-বিক্ষত হয়। সে হারিয়ে ফেলে মুখের ভাষা, ভেসে যায় বেদনার সাগরে কিন্তু কেন? কেন তার স্বামী তাকে ছেড়ে চলে গেছে? কেন সে আজ পাগলী নামে খ্যাত?
২
পাঁচ ভাইবোনের সংসারে সবার বড়ো তনুজা। পড়াশোনার প্রতি তার তেমন আগ্রহ ছিল না। বাবা-মায়ের চাপও ছিল না। গ্রামের আর পাঁচটা মেয়ের মতো তারও একটু তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। তখন বয়স কত ষোলো সতেরো হবে। এই বয়সে সংসারের বোঝা বওয়া গ্রামের মেয়েদের ললাট লিখন। পাশের পাড়ার সত্যেনের সাথে বিয়ে হলো তনুজার। শ্বশুরবাড়ি গিয়ে সে প্রথম জগৎ ও সংসারকে চিনতে ও বুঝতে শিখলো। তার স্বামী সত্যেন আদৌ তেমন কোনো কাজ করে না। বাবা মায়ের ঘাড়ে বসে বসে খায়। আইবুড়ো ছেলেদের ভার সব বাবা মা বহন করলেও বিবাহের পর ছেলে ও বৌমার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব কোনো বাবা মা নিতে চায় না। এক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয়নি। শুরু হলো সমস্যা। তনুজার শ্বশুর-শাশুড়ী তাদেরকে পৃথক করে দিলেন। কিভাবে চলবে তাদের সংসার? অসহায় তনুজা তার সমস্যা নিয়ে হাজির হলো বাবা-মায়ের কাছে। এ ঘটনা নতুন কিছু নয়। মেয়ের মুখ চেয়ে তার বাবা মা, মেয়ে জামাইকে সাহায্য করতে শুরু করলেন। শেষ পর্যন্ত শ্বশুরবাড়িতে আশ্রয় নিল সত্যেন।
সত্যেনের আর পরিবর্তন হলো না। আগে বাবার পয়সায় খেত, এখন শ্বশুরের পয়সায় খায়। সারাদিন আড্ডা মারে। খাওয়ার সময় বাড়ি ফেরে। তনুজার বাবা দেখলেন ভাবগতিক ভালো নয়। তার সংসারও যথেষ্ট বড়ো। অথচ জামাইয়ের মধ্যে কোনো হেলদোল নেই। বাধ্য হয়ে মেয়ের নামে পাঁচ কাঠা জমি লিখে দিয়ে সেখানে একটা বেড়ার ঘর বেঁধে দিলেন। সেই ঘরে তাদের নিজের মতো করে থাকতে বললেন। অলস সত্যেন আবার প্রমাদ গুনলো। খাটাখাটনি তার ধাতে সয় না। শুরু হলো তনুজার উপর অত্যাচার। কোনো উপার্জন নেই, সংসারও চলে না। তনুজার একমাত্র আশ্রয়স্থল তার বাবা মা ও ভাইয়েরা। তাদের সাহায্যেই দিন গুজরান হয়। ততদিনে সে একটা কন্যা সন্তানের মা হয়েছে। তবুও সত্যেনের দায়িত্ববোধ এলো না। উল্টে তার অধঃপতনের মাত্রা দিন দিন বাড়তে লাগলো। ধীরে ধীরে নেশা করতে শুরু করলো। এখানেই শেষ নয়। কানাঘুঁষো শোনা গেল যে সে বাড়িতে বাবা মাকে দেখতে যাওয়ার নাম করে তাদের পাড়ায় সাথী নামে এক বৌদির কাছে যায়। তার সঙ্গে নাকি অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে। তনুজার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। সে যে কী করবে কিছু ভেবে পেলো না। এক অজানা আশঙ্কায় কাঁপতে শুরু করলো।
৩
তনুজার আশঙ্কা একদিন সত্যি হলো। সাথীকে নিয়ে সত্যেন পালিয়ে গেল কলকাতায়। ভুলে গেল নিজের স্ত্রী ও কন্যার কথা। চোখে অন্ধকার দেখলো তনুজা। চারিদিকে খোঁজাখুঁজি শুরু হলো কিন্তু কোনো খবর পাওয়া গেল না। দু'মাস পর সাথীর টাকা পয়সা ফুরিয়ে যেতে ফিরে এলো সত্যেন ও সাথী তাদের নিজেদের ঘরে। সন্তান ও সংসারের ভবিষ্যতের কথা ভেবে সত্যেনকে আবার মেনে নিল তনুজা। স্বামীকে বললো- " মেয়েটা বড়ো হচ্ছে, ওর মুখের দিকে তাকিয়ে এবার অন্তত কিছু কাজবাজ করো।"
- ভাবছি অটো চালাবো। তবে ভাড়া চালিয়ে লাভ নেই। তাতে শুধু মালিকের পেট ভরবে। কিনতে পারলে ভালো হতো।
- সত্যি তুমি অটো চালাবে? কালই আমি বাবার কাছে যাবো। যাইহোক একটা ব্যবস্থা করবে।
তনুজা খুব খুশি হলো, তার স্বামী নিজে থেকে এই প্রথম রোজগার করার কথা ভেবেছে। পরের দিন তার বাবাকে সব বললো। তনুজার বাবা খুব একটা খুশি হতে পারলেন না। কারণ সত্যেনের উপর থেকে তার বিশ্বাস ও ভরসা উঠে গিয়েছিল। তবুও মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কয়েকদিন সময় চাইলেন। সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই জমি বন্ধক রেখে জামাইয়ের জন্য অটো কিনে দিলেন।
সত্যেন এখন অটো চালায়। সংসার একটু সচ্ছ্বল হয়েছে। তনুজার মনে একটু হলেও খুশি ও শান্তি ফিরে এসেছে। দেখতে দেখতে তনুজা দ্বিতীয় কন্যা সন্তানের মা হলো।
কুকুরের লেজ যতক্ষণ টেনে ধরে রাখা যায় ততক্ষণ সোজা থাকে। ছেড়ে দিলে আবার বেঁকে যায়। কুকুরের লেজের সাথে সত্যেনের কোনো তফাৎ নেই। কিছুদিন পর থেকে সে আবার পুরোনো ভূমিকায় ফিরতে শুরু করলো। অটো চালায় ঠিকই তবে টাকা বাড়িতে আসে না। নেশা ক'রে উড়িয়ে দেয়। ইদানিং সাথীর সাথে যোগাযোগটা আবার বেড়েছে। ক্লাবের ছেলেরা মারধরের হুমকি দিয়েছে। তবে তাতে কিছু হবে বলে তনুজা নিজেও আশা করে না। সে নীরবে চোখের জল ফেলে আর নিজের কপাল চাপড়ায়। বাচ্চা দুটোর ভবিষ্যতের কথা ভেবে তার চোখে ঘুম আসে না। তার মতো নারীদের আকুতি কিংবা অভিযোগ তো বিধাতার দরবার পর্যন্ত পৌঁছায় না। তাদের চোখের জলের মূল্য কে কবে দিয়েছে?
৪
গতবছর পুজোর সময় সত্যেন আবার সাথীকে নিয়ে পালিয়ে গেছে। আজ পর্যন্ত তাদের সন্ধান কেউ পায়নি। যাওয়ার আগে অটোর কাগজপত্র বন্ধক রেখে মোটা অঙ্কের টাকাও হাতিয়ে নিয়েছে একজনের কাছ থেকে। এই ঘটনার পর থেকে তনুজা মানসিক ভারসাম্য কিছুটা হারিয়ে ফেলেছে। সবার সাথে স্বাভাবিকভাবে কথা বলে কিন্তু সারাক্ষণ কী একটা গভীর চিন্তায় ডুবে থাকে। বাবা ভাইয়ের কাছে যাওয়ার মুখ আর তার নেই। সারাক্ষণ মেয়ে দুটোকে বুকে জড়িয়ে কাঁদে। কিভাবে সংসার চলবে, তাদের লেখাপড়া শেখাবে, মানুষ করবে সেই চিন্তায় সে দিশেহারা। অটোটা ভাড়া দিয়ে যে দু'পয়সা আসবে সে উপায়ও নেই। তনুজার চারদিকে অমাবস্যার অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই নেই। সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত ও বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে সে। তার সেই আলুথালু চেহারা ও ভাগ্য বিপর্যয়ের জন্য আজকাল অনেকেই তাকে পাগলী বলে ডাকে।
শেষ পর্যন্ত তনুজার ভাইয়েরা নিজেদের জায়গায় একটা চায়ের দোকান করে দিয়েছে, যাতে দু'পয়সা আসে। মেয়ে দুটোকে বাপের বাড়িতে রেখে সে এখন চা দোকান চালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করছে। কথায় বলে অভাগা যেদিকে চায়, সাগর শুকায়ে যায়। গত আম্ফান ঝড়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় তনুজার কুঁড়ে ঘর। আর যাইহোক সেটা আর বসবাসের উপযোগী নেই।
একের পর এক সরকারি ঘোষণা হতে শুরু করলো। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার পক্ষ থেকে ত্রাণ আসতে লাগলো। দুর্ভাগ্যের বিষয় কোথাও কোনো তালিকায় নেই তনুজার নাম। ভোট সর্বস্ব রাজনীতি ও পঞ্চায়েতি ব্যবস্থায় তনুজার কোনো মূল্য নেই। তার বাড়িতে যে একটা ভোটার! সে ক্ষমতাসীন দলের জন্য কী করেছে যে সরকারী অনুদান পাবে? সবাই ঘর ভাঙার লোন পাচ্ছে (ঘর না ভাঙলেও), ত্রিপল পাচ্ছে দেখে তনুজা আর্জি জানিয়েছিল পঞ্চায়েত সদস্য ভরত বাবুর কাছে। সে আর্জি তো মঞ্জুর হলো না। উল্টে চরম অপমান জুটলো তার কপালে। সে বুঝলো সরকারী সাহায্য তাদের মতো সর্বহারাদের জন্য নয়। ওটাতে একচ্ছত্র অধিকার রয়েছে পার্টির ঝাণ্ডাধারীদের।
৫
তনুজার এই দুঃসহ যন্ত্রণা জনপ্রতিনিধি বা নেতা বাবুদের মনে সহানুভূতি না জাগালেও কিছু মানুষকে ভাবিয়েছিল। তমাল কান্তি সরকার এমনই একজন ব্যক্তি। যিনি কোনো রঙ বা ঝাণ্ডার কাছে নিজের মনুষ্যত্বকে বিকিয়ে দেননি। যিনি অন্তরাত্মার ডাকে বারবার ছুটে যান অসহায় নিপীড়িত মানুষের পাশে। তিনি #সাথে_আছি নামক একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সক্রিয় সদস্য। তারই উদ্যোগে মাত্র ছয়টি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের গৃহ পুনর্নির্বাণের দায়িত্ব নিয়েছে #সাথে_আছি সংস্থা। বলাবাহুল্য সেই তালিকায় স্থান পেয়েছে তারা, যারা প্রকৃত অর্থে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও কোনো সরকারী সাহায্য পায়নি। তমাল বাবুর সৌজন্যে তনুজার গৃহনির্মাণের কাজ চলছে। মেয়েটা খেতে পাক আর নাই পাক , এবার অন্তত বাচ্চা দুটোকে নিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারবে। বৃষ্টি হলে তাকে আর মেয়েদেরকে বুকে জড়িয়ে ছেঁড়া পলিথিনের নীচে মাথা লুকোতে হবে না। একটা ত্রিপলের জন্য ভরত বাবুদের কটাক্ষ তাকে আর সহ্য করতে হবে না। সত্যেন স্বামী হয়েও দায়িত্ব পালন করেনি, পাশেও থাকেনি। ভরতবাবু জনপ্রতিনিধি হয়েও কর্তব্য পালন করেননি, পাশে থাকার প্রশ্নই ওঠে না। স্বজনপোষণ আর নিজের পকেট ভরতেই তিনি ব্যস্ত। তারপরেও রাজনৈতিক ছত্রছায়ার বাইরে তমাল বাবুদের মতো মানুষজন আছেন। যারা শিব জ্ঞানে জীব সেবার লক্ষ্য নিয়ে পৌঁছে যান মুমুর্ষু মানুষের পাশে। তাই কত অসহায় তনুজারা আজও বেঁচে থাকার শেষ লড়াইটা চালিয়ে যাওয়ার রসদ পাচ্ছে।
0 Comments