কলমে : কল্প দেব চক্রবর্তী
কমলের পুরনো দিনের জিনিসপত্র কেনা একটা নেশার মতন।
সেদিন বিডনস্ট্রিটে একটা পুরনো জিনিসপত্র কেনার দোকানে গিয়েছিল একটা কলের গান কিনতে। দরদস্তুর পাকা করে কলেরগানটা যখন প্যাকিং করে দিচ্ছে দোকানদার, তখন কমলের নজরে পড়লো বেশ বড়োসড়ো একটা ডল পুতুলের দিকে।
দোকানীকে জিজ্ঞেস করলো পুতুলটার দাম কত? দোকানী অন্যমনস্ক ভাবে পুতুল টার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, " দাম দিতে হবে না আপনি নিয়ে যান। "
কমল অবাক হল। " সে কি, এত সুন্দর পুতুল দাম দিতে হবে না?"
দোকানী বললো, " এর আগে যারাই ওকে নিয়ে গেছে আবার ফিরিয়ে দিয়ে গেছে। আপনিও তেমন ভাবে ওকে আবার নিয়ে আসবেন।"
কমল অবাক হয়, "সে কি কেন? "
দোকানী বলে, " আপনি না হয় ওকে যখন ফেরত দিতে আসবেন তখনই বলবেন কেন?"
যাইহোক কমলের খুব আনন্দই হল। কলের গানের সাথে অত সুন্দর একটা পুতুল ফ্রিতে পাওয়া গেল দেখে।
রাত তখন অনেক। কমল কখন যেন কলের গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছে। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল একটা বাচ্চার কান্না শুনে।
কমল ধড়মড় করে উঠে বসলো। চোখ দুহাতে কচলে নিয়ে অন্ধকার চোখ সহয়া হয়ে আসতেই দেখল পুতুলটা কলের কানের পাশে বসে কাঁদছে। রীতিমত চোখ দিয়ে জল পরছে।
কমলের সারা গায়ের লোম কাটা হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। গানটা কখন যেন যেন শেষ হয়ে একটা ঘরঘর আওয়াজ হচ্ছিলো। দ্রুত হাতে কলের গানটা বন্ধ করতেই দেখল পুতুলটা আগের জায়গায় খোলা আলমারির তাকেই বসে আছে।
মনের ভূল ভেবে কমল আবার শুয়ে পড়ল।সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল।
কতক্ষণ ঘুমিয়েছে মনে নেই, ঘুমের ঘোরে ওর মনে হলো কে যেন ওর বুকের উপরে চেপে বসে আছে। কমল চেষ্টা করেও তাকে ঠেলে সরাতে পারছে না। আর রোমহর্সক শিশু কন্ঠে হাঃ হাঃ হিঃ হিঃ অট্টহাসি।কমল মুখে রাম রাম রাম জব করছে। অবাক বিস্ময়ে দেখল পুতুলটা তার বুকের উপরে চেপে বসে আছে।
কমল আরো জোরে জোরে রাম নাম জপ করতে থাকল। হঠাৎ অনুভব করল বুকটা হালকা হয়ে গেল।
উঠে তড়িঘড়ি লাইট জ্বালালো কমল। এই শীতেও সারা গা ঘামে ভিজে চপ্ চপ্ করছে। আলমারির তাকের দিকে তাকিয়ে দেখলো,পুতুলটা আগের জায়গাতেই বসে আছে।
সকাল হতেই কমল পুতুলটাকে নিয়ে ছুটলো বিডনস্ট্রিটে সেই দোকানদারের কাছে।দোকানী নিরুত্তাপভাবে কমলের দিকে তাকাল।কমলের হাতের দিকে তাকিয়ে বলল, "ওকে দিতে এসেছেন? কলেরগানটা আনেননি? "
কমল বলল, " সমস্যা তো এই পুতুলটাকে নিয়ে। কলেরগান আনব কেনো! ওটা আমার খুব প্রিয়, আমি ওটা ফেরত দেবনা।"
দোকানী ভাবলেশহীন মুখে পুতুলটা ফেরত নিয়ে আগের জায়গায় বসিয়ে রাখল।
কমল বললো, " বলুনতো কি ব্যাপার? ভূতটুতের কোনো ব্যাপার না কি? মানে অশরীরী আত্মা টাত্মা? "
দোকানী বললো, " তবে কাল আপনি আবার আসবেন।তখন আপনার মুখেই শুনবো।"
কমল এই হেঁয়ালির মানে বুঝতে পারলো না। ভূতটুতে ওর তেমন বিশ্বাস ও নেই। সমস্ত ঘটনাটাই মতিভ্রম মনে করেই কমল খুশিমনে বাড়ি ফিরে এলো।
রাতের খাওয়া দাওয়া শেষ করে একটা সিগারেট ধরিয়ে দেদার সুখটান দিয়ে কলেরগান চালিয়েদিয়ে চেয়ারে গা এলিয়ে দিল। ঘুমোতে যাওয়ার আগে গান শোনা কমলের একটা পুরনো অভ্যেস। রাত নিঝুম হলে দুঃখের করুন সুরের গান গুলো কমলের মনে অপূর্ব একটা মূর্ছনা বয়ে আনে। সেদিনও এমন একটা করুন গান চালিয়ে কমল চেয়ারে গা এলিয়ে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে রইল। যদি শুয়ে পড়ে, ঘুম এসে গেলে কলের গান বন্ধ করা হবে না এই ভেবেই সে চেয়ারে আধশোয়া হয়ে বসে রইল। হয়তো আগেরদিন রাতের কথা মনে পড়ে একটু ভয় ভয় করছিল।
সবে চোখটা লেগে এসেছে আর ঠিক তখনই সেই কান্নার আওয়াজ ভেসে এলো।
কমল ধরমর করে সোজা হয়ে বসল। নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না। সেই পুতুলটা কলের গানের পাশে বসে কাঁদছে।
তাড়াতাড়ি কলের গানটা বন্ধ করে দিতেই পুতুলটাকে আর দেখতে পেল না। না আলমারির নির্দিষ্ট জায়গাটাতেও যেখানে পুতুলটা আগে ছিলো সেখানেও নেই। ঘরে আনাচে কানাচে আতিপাতি করে খুঁজেও দেখলো, না কোথাও নেই পুতুলটা!
কমলের সারা দেহ মন ভয়ে-আতঙ্কে রোমাঞ্চিত হতে থাকলো। সে রাত্রে আর দু'চোখের পাতা এক করতে পারল না কমল। যে মানুষটা সারা জীবন ভুত প্রেত বিশ্বাস করে না সে কেমন যেন আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে রইল। এইবুঝি কেউ বুকের উপর চেপে বসে!
ভয়ে ভয়ে ভোর হল। না তেমন কিছু আজ হলো না। কমল দেখলো হঠাৎ একটা দমকা হাওয়াতে জানালা ধড়াস করে খুলে গেল। কে যেন সেখান থেকে বেরিয়ে গেল।
তারপর আবার সব নিশ্চুপ।
পরেরদিন সকাল হতেই কমল কলেরগান নিয়ে সেই দোকানে হাজির হল। দোকানী কলের গান টা কমলের হাত থেকে নিয়ে সেই আগের জায়গাতেই পুতুলের পাশে রেখে দিল। কমল দেখলো পুতুলটা মিট মিট চোখে তাকিয়ে হাসছে। যেন কলের গানটা ফিরে পেয়ে খুব খুশি।
কমল দোকানীকে সব ঘটনা খুলে বর্ণনা করল। দোকনী বলল, এই গল্প বহুবার তার শোনা। আগেও যারা এই কলের গান বা পুতুল যেটাই কিনেছে তাদেরও একই অভিজ্ঞতা হয়েছে। আবার একইভাবে তারাও এইভাবে ফেরত দিয়ে গেছে।
কমল দোকানীর হাত চেপেধরে বলল, " বলুন এর পেছনে ইতিহাসটা কি?"
দোকানী বলল, " আমিও বিশেষ কিছু জানিনা। এই পুতুলটা ছিল একটি সুন্দর ফুটফুটে ছোট্ট শিশুর। তার বাবা ছেলের জন্মদিনে ওটি তাকে কিনে দিয়েছিল। অনেক খেলনার মধ্যে এই পুতুলটিই ছেলেটির সবচেয়ে প্রিয় ছিল।
ছেলেটির বাবা বিখ্যাত গায়ক ছিল। একদিন গভীর রাতে জলসা থেকে ছেলেটির বাবা গাড়ি করে ফিরছিল। পথে একটি ট্রাকের সাথে এক্সিডেন্টে তার বাবা মারা যায়।
অতোটুকু শিশু মৃত্যু কি তা বোঝে না। সে তার বাবার গাওয়া গানের রেকর্ড গুলো ওই কলের গানে শুনতো, আর উদাশ ভাবে আকাশের দিকে চেয়ে থাকত, বাবা কখন আসবে।
এমনভাবে বহুদিন কেটে গেল। নিয়তির অমোঘ টান আর কাকে বলে। একদিন ওই পথেই ছেলেটি মার সাথে কোনও এক আত্মীয়র বাড়ি থেকে ফিরছিল। আর ঠিক একই জায়গায়, যেখানে তার বাবার অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল সেখানেই গাড়িটি দুর্ঘটনাগ্রস্ত হয়।ছেলেটি,ছেলেটির মা সহ ড্রাইভার তিনজনেই মারা যায়।
বাড়িটাতে সেই থেকে আর কেউই বসবাস করতে পারেনি। সম্পর্কীয় আত্মীয়স্বজনরা বাড়িটা বিক্রি করে চলে যান।
বাড়ির চাকর পুরনো জিনিসপত্রের সাথে ওই পুতুল আর কলেরগানটি আমাকে দিয়ে যায়।
তারপর, তারপর একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। ওই পুতুলটির মধ্যে শিশুটির আত্মা এসে ভর করে।তার প্রিয় বাবাকে খুঁজতে থাকে।তাই গান বন্ধ হলেই সে ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে।
কমল দীর্ঘশ্বাস ফেলে। " ও গড তুমি ওদের আত্মার শান্তি দাও।"
------------ সমাপ্ত -------------
0 Comments