উত্তরণের পথে | Bengali realistic story


কলমে : পলাশ হালদার

         ‌                         ১

"কিছু মনে ক'রো না সুরভী, আমাকে এখনই যেতে হবে। না হলে ওরা মেরে ফেলবে। আমি বাঁচতে চাই। তাই আজ পালাতে বাধ্য হচ্ছি। যদি বেঁচে থাকি আবার আমি তোমার কাছে ফিরে আসবো।.... আমি যেন আবার ফিরে আসতে পারি এই প্রার্থনা ক'রো।" কথাটা বলে সাত্যকি ঘর থেকে দ্রুত বেরিয়ে গেল। সুরভী কিছু বলার চেষ্টা করছিল -তাকে কোথায় ফেলে পালিয়ে যাচ্ছে সাত্যকি! সে কিভাবে একা বাঁচবে? সে সব কথা শোনার সময় পেলো না, ততক্ষণ অনেকটা দূরে চলে গেছে সাত্যকি। রাতের অন্ধকারে তাকে আর দেখা যাচ্ছে না। মিনিট দশেকের মধ্যে জনাদশেক মানুষ দরজায় ধাক্কা মারতে লাগলো সাত্যকির নাম ধরে চিৎকার করতে করতে। ভীতসন্ত্রস্ত সুরভী দরজা খুলে দিতেই তাদের একের পর প্রশ্ন- "শুয়োরের বাচ্চাটা কোথায়?ও কী ভেবেছে? আমাদের টাকা মেরে দিয়ে বেঁচে যাবে? এই চণ্ডীপুরের মাটিতে ওকে জ্যান্ত পুঁতে দেবো।"
মানুষগুলোর রণং দেহি মূর্তি দেখে ভয়ে কেঁপে উঠলো সুরভী। এতক্ষণ পর সে বুঝতে পারলো একটু আগে তার স্বামী কেন ভয়ে পালিয়েছে! কেন সে তার শেষ কথাগুলো না শুনে, কোনো জবাব না দিয়ে তাড়াতাড়ি চণ্ডীপুর ছেড়ে দূরে চলে গেছে।  
সুরভীর কাছে তারা যখন জানতে পারলো যে সাত্যকি চণ্ডীপুর ছেড়ে অন্য কোথাও চলে গেছে তখন সেই উন্মত্ত মানুষগুলো তাকে খুঁজে বের করে প্রাণে মারার হুমকি দিয়ে সেই স্থান ত্যাগ করলো। দরজাটা বন্ধ করে বিছানায় প'ড়ে বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতে শুরু করলো সুরভী। তার জীবনে তাহলে শেষ পর্যন্ত এই ছিল! মনে পড়ে গেল তার বাবার সেই অভিশাপের কথা‌। বছর খানেক আগে তার বাবা বলেছিলেন-"তুই বুঝতে পারবি কত বড় ভুল করছিস। জীবনে কোনোদিন সুখী হতে পারবি না। ভিখারির মতো এসে আমার পায়ের কাছে ভিক্ষে চাইতে হবে।"  আজ সেই কথাগুলো বারবার মনে পড়ছে সুরভীর।

                                      ২

সুরভি তখন দশম শ্রেণীতে পড়ছে। সামনে মাধ্যমিক, ছাত্রী হিসেবে অত্যন্ত মেধাবী। শিক্ষক-শিক্ষিকাগণের আত্যন্ত প্রিয়পাত্রী। এলাকায় যথেষ্ট জনপ্রিয়। তার বাবা  শিক্ষক। সেই হিসাবে সবদিক দিয়ে পরিচিতি ও খ্যাতির মধ্যগগনে বিরাজ করছে তখন সুরভী। সাত্যকি একাদশ শ্রেণীর ছাত্র, পড়াশোনায় বলার মতো তেমন কিছুই নয়। তার না আছে পারিবারিক ঐতিহ্য, না আছে আর্থিক কৌলীন্য। পড়াশোনার জন্য চণ্ডীপুরে একটা মেসে থাকতো। আর পাঁচজন ছাত্রের মতো সেও সুরভীর রূপ ও গুণে আকৃষ্ট হয়েছিল। আর সুরভী যে এতো প্রেমিককে উপেক্ষা ক'রে কী কারণে সাত্যকির প্রেমে বাঁধা পড়েছিল তা একমাত্র সেই জানে। প্রেমে পড়া হয়তো ভুল নয় কিন্তু তবুও তারা দু'জন জীবনে সবচেয়ে বড়ো ভুলটা করে বসলো। হ্যাঁ, সুরভীর মাধ্যমিক পরীক্ষার আগেই একরকম অপরিণত বয়সে দু'জনে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলো। কোনো ভবিষ্যৎ নেই, কোনো পরিকল্পনা নেই। আবেগের বশে হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো তারা। ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন সুরভীর বাবা সুশোভনবাবু। নিজের মানসম্মান তো গেলো, সেই সঙ্গে সুরভীর আগামী দিনগুলো ভেবে আতঙ্কিত হয়ে পড়লেন। মেয়ের বয়স তখন আঠেরো হয়নি। আইনের পথে গেলে সে বিয়ে ভেঙে দিতেও পারতেন। কিন্তু তিনি এতটাই আঘাত পেয়েছিলেন যে সে সব দিকে অগ্রসর হননি। গভীর দুঃখে ও অভিমানে মেয়ের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করেন। সুরভীর কাছে তার প্রত্যাশা ছিল অনেক বেশী। সেই প্রত্যাশা ভঙ্গের বেদনায় মুষড়ে পড়েন সুশোভনবাবু।

বিয়ের পর স্কুল ছাড়লো সাত্যকি। বাড়িতে গেলে বাবা মাও ঘরেতে জায়গা দিলেন না। সবার অজান্তে এভাবে বিয়েটা কেউ মানতে নারাজ। তারা দু'জন আবার ফিরে এলো চণ্ডীপুরে। একটা ছোট্ট ভাড়া বাড়িতে শুরু করলো সংসার জীবন। সাত্যকি টুকটাক কাজে মন দিল। সুরভী প্রস্তুতি শুরু করলো মাধ্যমিক পরীক্ষার। ঘরে ভীষণ অভাব তবে ভালোবাসায় কোনো ঘাটতি নেই। এইসময় আর্থিক দুরাবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার মোহে সাত্যকি যোগ দিল এক চিটফান্ড কোম্পানিতে। তখন ওই কোম্পানির বেশ সুনাম চারদিকে। বিভিন্ন নেতা মন্ত্রীদের দেখা যায় ওই কোম্পানির বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। স্বাভাবিকভাবে বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব ছিল না। তরতর করে এগোতে থাকে সাত্যকি। চণ্ডীপুরের মানুষ সরল বিশ্বাসে অর্থ সঞ্চয়ের জন্য তা তুলে দেয় সাত্যকির হাতে। ইতিমধ্যে সুরভী আশানুরূপ ফল করতে না পারলেও মাধ্যমিক পাশ করলো। আর তখনই হঠাৎ করে সবাই জানতে পারলো সাত্যকির কোম্পানি সাধারণ মানুষের টাকা চোট করে পালিয়ে গেছে। মাথায় হাত সবার। এতো কষ্টের টাকা এভাবে সব জলে গেল! প্রাথমিক হতাশা কাটার পর সমস্ত রোষ গিয়ে পড়লো সাত্যকির ওপর। তারা তো কোম্পানি দেখেনি, তারা সাত্যকিকে দেখে টাকা দিয়েছিল। তাই তাদের টাকা সাত্যকিকেই ফেরত দিতে হবে। প্রথম প্রথম অনুরোধ, অনুনয়, বিনয় চললো। তারপর যত দিন বাড়তে লাগলো মানুষগুলোর শরীরি ভাষা পাল্টাতে শুরু করলো। তাদের ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে গেল। শারীরিক আক্রমণের পরিকল্পনা করলো। আর তা জানতে পেরে প্রাণের ভয়ে পালিয়ে গেল সাত্যকি। এখন কী হবে সুরভীর? তাহলে কি সত্যি হবে সুশোভন বাবুর আশংকা?

                                        ৩

আতঙ্কিত দিকভ্রান্ত সাত্যকি শেষ পর্যন্ত এক বন্ধুর সাথে পৌঁছে গেল কলকাতার খিদিরপুর অঞ্চলে। সেই বন্ধু জাভেদ ভাইয়ের কারখানা থেকে চিপস নিয়ে বিভিন্ন বাজারে পাইকারি দামে পৌঁছে দেয়। দিনের শেষে রোজগণ্ডা বুঝে নিয়ে আশ্রয় নেয় বস্তির একটা ছোট্ট ভাড়া ঘরে। বস্তির সেই এক চিলতে ঘর এখন সাত্যকির মাথা গোঁজার একমাত্র ঠাঁই। তার বন্ধু বলে ক'য়ে জাভেদ ভাইয়ের কাছে সাত্যকির একটা ব্যবস্থা করে দিল। সেও কারখানা থেকে চিপস নিয়ে বিভিন্ন বাজারে পাইকারি দামে দিতে শুরু করলো। অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই সাত্যকি ব্যবসা বেশ জমিয়ে ফেললো। বহু পুরানো সেলসম্যান অপেক্ষা তার মাল কাটে বেশি। তার হিসাবপত্র‌ও খুবই স্বচ্ছ। ফলে জাভেদ ভাইয়ের নজরে পড়তে দেরি হলো না। খুব তাড়াতাড়ি মালিকের প্রিয়পাত্র হয়ে গেল। একদিন জাভেদ ভাই তাকে ডেকে বললেন- "সাত্যকি তোমাকে আর সেলসের কাজ করতে হবে না। আজ থেকে তুমি কারখানায় থাকো। হিসেবপত্র দেখো, কে কত মাল নিয়ে যাচ্ছে, কত ফেরত আনছে। আমার বিশ্বাস তুমি হিসাবপত্র ঠিকঠাক রাখতে পারবে। আমি বহুদিন ধরে এমন একটা বিশ্বাসী লোক খুঁজছিলাম যার উপর নিশ্চিন্তে হিসেবপত্র রাখার দায়িত্বটা দিতে পারি।" মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকে সাত্যকি। জাভেদ ভাই জিজ্ঞাসা করলেন- "তুমি কিছু বলবে? কোনো অসুবিধা হলে বলতে পারো।"
- না স্যার, আপনি আমার উপরে ভরসা রেখেছেন এটা আমার অনেক বড় পাওনা। বহু মানুষের আস্থা হারিয়ে আজ আমি আপনার কাছে একরকম পালিয়ে এসেছি। চেষ্টা করবো আপনার বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে।

জাভেদ ভাইয়ের কারখানায় দিনে দিনে সাত্যকির ভূমিকা বাড়তে থাকলো। তার কর্মদক্ষতা বিশ্বাসযোগ্যতা সবকিছুই তার গুরুত্ব বাড়াতে লাগলো। পয়সাকড়িও আসতে শুরু করলো। এবার সে সুরভীকে টাকা পাঠাতে শুরু করলো কিন্তু চণ্ডীপুরে আসার মতো সুযোগ ও সাহস তখনো হয়নি। সুরভীকে চিঠি লিখলো-
                                     সোনা,
                                                 জানি তুমি খুব কষ্টে আছো। তবে বিশ্বাস করো আমার কিছু করার ছিল না। শুধু বাঁচবো বলে পালিয়ে এসেছিলাম। একবারও ভাবিনি তোমার কী হবে। আমাকে ভালোবাসো বলে হয়তো ক্ষমা করে দেবে কিন্তু আমি এখনও ক্ষমার যোগ্য হয়ে উঠতে পারিনি। আজ প্রথম তোমার কাছে টাকা পাঠালাম। আমার রক্ত জল করা টাকা। ভেঙে প'ড়ো না সোনা। আমি সবার সব পাওনা মিটিয়ে দেবো। তুমি মাথা উঁচু করে বাঁচবে। তোমার সব স্বপ্ন পূরণ করবো। আমার উপর ভরসা রাখো আর একটু সময় দাও। এখন দিনরাত নিজেকে কাজের মধ্যে ডুবিয়ে দিয়েছি। তবে একদিন আসবে যেদিন তোমাকে নিয়ে আবার ভালবাসায় ভেসে যাবো। ভালো থেকো।
            ‌                                   ইতি-
                                                 তোমার জীবন

সীমাহীন অন্ধকারের মাঝে সুরভী যেন এক চিলতে আলোর দেখা পেল। এতদিন নানা দুশ্চিন্তায় তার সময় কেটেছে। অনাহারে-অর্ধাহারে দিনরাত কেটেছে কিন্তু মাথা নিচু করে বাবার কাছে আশ্রয় নেয়নি। আজ সাত্যকির চিঠি আর টাকা পেয়ে সেটাকে বুকে আঁকড়ে ধরলো। এটার মূল্য যে তার কাছে কত সেটা সে মর্মে মর্মে অনুভব করতে লাগলো। আশায় বুক বাঁধলো একদিন এই ঝড় থেমে যাবে, একদিন এই অন্ধকার দূর হবে। আবার সে তার প্রাণের মানুষটার হাত ধরে মাথা উঁচু করে বাঁচবে। ভগবান যখন মুখ তুলে তাকান তখন আর কোনো কিছুরই প্রয়োজন হয় না। সাত্যকির অগ্রগতির ধারা দুর্বার গতিতে এগিয়ে চললো। নিঃসন্তান জাভেদ ভাইয়ের কারখানায় সে এখন দ্বিতীয় ব্যক্তি। তার অবর্তমানে সমস্ত দিক সে একা হতে সামলায়। জাভেদ ভাইও এখন অনেকটাই নিশ্চিন্ত।

                                            ৪

সাত্যকির চোখে এখন অনেক বড়ো স্বপ্ন। ইতিমধ্যে সে চণ্ডীপুরের সবার পাওনা কড়ি মিটিয়ে দিয়েছে। সুরভীর কাছে আসা যাওয়াও বেড়েছে। বেড়েছে সম্মান। সবার কাছে সে এখন স্বচ্ছ, সৎ ও আদর্শবান যুবক। অর্থ যে কিভাবে মানুষের চরিত্রের সংজ্ঞা পাল্টে দেয় তা সে খুব ভালো ভাবে বুঝেছে। একদিন জাভেদ ভাইয়ের কাছে গিয়ে বললো-" স্যার কিছু মনে করবেন না, ভুল বুঝবেন না। আমি একটা সিদ্ধান্ত নিতে চলেছি। সেটা কাউকে না জানিয়ে গোপনেও করতে পারতাম কিন্তু আজ আমি যে জায়গায় এসে পৌঁছেছি তা শুধুমাত্র আপনার জন্য। আপনার সাথে বেইমানি করা আমার পক্ষে অসম্ভব। আপনাকে ঠকাতে পারবো না। আমি আপনার অনুমতি চাই, আপনার আশীর্বাদ চাই। আপনার পরামর্শে আমি এগোতে চাই।"
- কী ব্যাপার সাত্যকি হঠাৎ এইসব কথা!
-  আমি নিজের একটা কারখানা খুলতে চাই। আপনি যদি আমাকে অনুমতি দেন তাহলে আগামী দু'এক মাসের মধ্যে আমার নিজের কারখানার কাজ শুরু করতে চাই। আপনি না অনুমতি দিলে আমি জোর করে আপনার কারখানা ছেড়ে যাবো না। সারাজীবন আপনার গোলাম হয়ে থাকলেও আপনার ঋণ আমি শোধ করতে পারবো না।
 কথাটা শুনে চমকে উঠলেন জাভেদ ভাই। বললেন - সাত্যকি, বসো। তোমাকে আজ আমার অনেক কিছু বলার আছে। এভাবেই বড়ো বড়ো স্বপ্ন দেখতে হয়, না হলে বেশি দূর এগোনো যায় না। তবে আমি তোমাকে ছাড়বো না। তুমি ছেড়ে চলে যেতে চাইলেও ছাড়তে দেবো না। তুমি কি মনে করো আমার এই ব্যবসাটা শুধুমাত্র ব্যাংক ব্যালেন্স বাড়ানোর জন্য? তুমি তো জানো আমার কোনো উত্তরসূরী নেই। তবুও আমার ধ্যান-জ্ঞান স্বপ্ন এই কারখানা। তুমি হয়তো জানো না আজ থেকে তিরিশ বছর আগে সুন্দরবনের আমলামেতি বলে একটা জায়গা থেকে ঠিক তোমার মতো পালিয়ে এসেছিলাম এই কলকাতায়। তারপর তীব্র জেদ আর লড়াইয়ের জোরে আমি এখানে এসেছি। কারখানা করেছি, ঘর করেছি, সংসার পেতেছি। আজ এখানে কয়েক'শ ছেলের রুটি-রুজির সংস্থান হয়েছে। এটাকে অবলম্বন করে কত মানুষ বেঁচে আছে সেটা তুমিও জানো। শুধু এই মানুষগুলোকে ভালো ভাবে বাঁচার জন্য, তাদের একটু সুখ-স্বাচ্ছন্দ বিলিয়ে দেওয়ার জন্যই আমার এই কারখানা। আমি জানি মানুষ বাঁচার জন্য কিভাবে চারদিকে ছুটে বেড়াচ্ছে। যেভাবে আমি এসেছিলাম, যেভাবে তুমি এসেছিলে, প্রতিদিন সেইভাবে কত মানুষ গ্রাম থেকে শহরে ছুটে আসছে। তাদের সবাইকে আমি বাঁচাতে পারিনি, তুমিও পারবে না। কিন্তু কয়েকজনকে তো পারবো। তুমি যদি ছেড়ে চলে যাও আমার পক্ষে মনে হয় এটাকে রক্ষা করা খুব কঠিন হয়ে যাবে। তাছাড়া আমার তো বয়স হয়েছে, আমাকেও তো চলে যেতে হবে। এই কারখানার ভবিষ্যতের মালিক তুমি। তোমার মধ্যে মানুষের জন্য দরদ দেখেছি। তোমার মধ্যে সততা ও নিষ্ঠা দেখেছি। তুমি শুধু এই কারখানাটাকে বাঁচাতে পারবে না, তুমি বহু মানুষের আশ্রয় দেবে। তুমি নিজের জন্য যে স্বপ্নটা এই মুহূর্তে দেখছো, সেই স্বপ্নটা এই কারখানাটাকে ঘিরে দেখো। এর পঞ্চাশ শতাংশ মালিকানা আমি তোমার নামে লিখে দিচ্ছি।
কথাগুলো শুনে সাত্যকি আর বসে থাকতে পারলো না। মাথা নিচু করে জাভেদ ভাইয়ের পায়ে হাত দিয়ে বললো- "স্যার, এতদিন আপনাকে আমি পুরোপুরি চিনে উঠতে পারিনি, আমাকে ক্ষমা করবেন। আজ থেকে আপনার স্বপ্ন আর আমার স্বপ্নের আলাদা কোনো রং থাকবে না। আপনি দেখুন কারখানাটাকে কোথায় নিয়ে যাই।"

জাভেদ ভাই প্রতিশ্রুতি মতো কারখানার অর্ধেক মালিকানা তুলে দিয়েছেন সাত্যকির হাতে। কারখানার পাশেই একটা ফ্ল্যাট কিনেছে সাত্যকি। তার প্রাণপ্রিয়া সুরভীকে নিয়ে সেখানে রচনা করেছে সুখের স্বর্গ। সুরভী আবার নতুন করে  পড়াশোনা শুরু করেছে। তার স্বামী তাকে লক্ষ্য বেঁধে দিয়েছে - শুধু উচ্চ মাধ্যমিক বা বি এ পাশ করলে হবে না, যেভাবেই হোক তাকে এম এ পাস করতেই হবে। চাকরি বাকরি বা পয়সার জন্য তাকে আবার লেখাপড়ার জগতে ঠেলে দেয়নি সাত্যকি। সে চায় সুরভীর মধ্যে যে মেধা ছিল তার যেন পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে। শুধু তারা দু'জন বা সুশোভন বাবু নয় , সমগ্র চণ্ডীপুর স্বপ্ন দেখেছিল সুরভী একদিন বড়ো বিদ্বান হবে। সেই স্বপ্নটা মরে যেতে বসেছিল অনুকূল পরিবেশের অভাবে। সুসময় ফিরতেই সাত্যকি আবার সুরভীর মধ্যে লেখাপড়ার সেই নেশাটা জাগিয়ে তুললো।

                                           ৫

দশবছর পেরিয়ে গেছে। চলে গেছেন জাভেদ ভাই। চলে গেছেন সুশোভন বাবুও। তবে তারা যাওয়ার আগে দেখে গেছেন সাত্যকি ও সুরভীর সাফল্য। সুরভী তার পছন্দের বিষয় ভূগোল নিয়ে মাস্টার ডিগ্রী সম্পন্ন করেছে। তবে শিক্ষকতা বা অন্য কোনো চাকরির পথে যায়নি। তার স্বামীর পাশে থেকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে কারখানা সম্প্রসারণে। জাভেদ ভাইয়ের সেই কারখানা শুধু কলেবরেই বাড়েনি। সেখানে এখন কয়েক হাজার মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ হচ্ছে। চণ্ডীপুর থেকে পালিয়ে যাওয়া ছেলেটা এখন কত শত মানুষের আশা আকাঙ্খা, জীবন জীবিকার ভরসার স্থল। সাত্যকি মরতে দেয়নি জাভেদ ভাইয়ের স্বপ্নকে। বরং তা ক্রমশ আকাশ ছোঁয়ার লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছে। সুশোভন বাবুও পরম তৃপ্তি নিয়ে এই পৃথিবী ছেড়েছেন। তিনি দেখে গেছেন সুরভী শুধু সুশোভন মাস্টারের মেয়ে নয়, সাত্যকির যোগ্য সহধর্মিণীও বটে।
 অর্থ উপার্জন‌ই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য নয়, আপন যশ খ্যাতিই পরম মোক্ষ নয়। একে অপরের ভালোবেসে হাত ধরে পাশাপাশি হেঁটে শুধু নিজেদের স্বপ্ন পূরণ করা যায় না, আরো অনেককে উত্তরণের পথে এগিয়ে দেওয়া যায়। সাত্যকির লড়াই, সুরভীর তিতিক্ষা আজ চণ্ডীপুরের মানুষের মুখে মুখে ফেরে। আমাদের চারপাশে এমন কত সাত্যকি, সুরভীরা প্রতিনিয়ত পড়ে পড়ে মার খাচ্ছে, অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে। সবাই তো আর জাভেদ ভাইয়ের মতো মানুষের দেখা পায় না। তাই কত লড়াই মূল্যহীন হয়ে যায়, দেখতে পায় না উত্তরণের পথ। তবে যারা সেই আলোর সন্ধান পায়, তারা আরো কিছু মানুষকে আলোর পথ দেখান। তাই আজ‌ও মানুষ বেঁচে আছে, মানুষ কথার অর্থ আজ‌ও বোধগম্য হয়।

Post a Comment

0 Comments