লকডাউনে লাভ রোমান্স | Bengali love story



কলমে : মধুপর্ণা ব্যানার্জী

(১)

 টিভি দেখতে দেখতে মাথাটা গরম হয়ে ওঠে মৈনাকের। এতো আচ্ছা বিপদে পড়া গেল। হঠাৎ করে এই লকডাউনের ঘোষণা হবে সে বিন্দুমাত্র কল্পনা করতে পারেনি, এবার কাজের জন্য মুম্বাই এসে আটকে গেছে, কি করে যে কলকাতায় ফিরবে বুঝতে পারে না, এখন মুম্বাইয়ের অবস্থা তো খুব খারাপ। তবুও একটা বিশাল বড়ো আশ্রয় হলো বন্ধুর এই ফ্ল্যাট, এই আশ্রয়টা না থাকলে আরো বিপদে পড়তো। অনিক মুম্বাইয়ে থাকার সময় এই ফ্ল্যাটটি কিনেছিলো, এখন সে কয়েকবছরের জন্য আমেরিকা তে গেছে।তাই তার কাছে ফ্ল্যাটের চাবি দিয়ে গেছে। কাজের জন্য প্রায় প্রতি মাসেই মুম্বাইয়ে আসে মৈনাক। তবে এইরকম পরিস্থিতি ভাবাই যায়না।

বাড়িতে মাকে ফোন করে সব খবর নেয়। এইসময় বাবাকে যেন বাইরে বেরোতে না দেয়, সেইজন্য বারবার সাবধান করে।মা , বাবার বয়স হয়েছে... এই অবস্থায় এতো কাজ সবকিছু ঠিকঠাক সামলাতে পারবে কিনা সেই নিয়ে চিন্তা হয় তার। কিন্তু করার তো কিছুই নেই। এখন বাড়িতে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই।

বন্ধুরা যে যার নিজের জগতে ব্যস্ত। একবছর আগে ব্রেকআপ হয়ে গেছে... মৈনাকের এখন একাকীত্বই জীবন। এর আগে যখন অনিকের ফ্ল্যাটে এসেছে তখন চারদিকে চোখ মেলে দেখার সময় বা সুযোগ হয়নি। এখন তো হাতে অপরিমিত সময়। ওয়ার্ক ফ্রম হোম... এর দায়দায়িত্ব সামলেও প্রচুর খালি সময়।কতো আর ঘুমিয়ে, রান্না করে, টিভি দেখে ভালো লাগে... 

মৈনাক ভাবে এই তো লকডাউনের শুরু, এরপর দিনগুলো কিভাবে যে কাটবে, হঠাৎ করেই মনে হয় বেডরুমের লাগোয়া বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়... রাস্তায় লোকজন প্রায় নেই বললেই চলে। ঘরে ঢুকতে গিয়ে পাশের ফ্ল্যাটের ব্যালকনির দিকে নজর পড়ে যায়। একটি অল্পবয়সী তরুণী দাঁড়িয়ে আছে , হাতে কফির মগ। হাওয়ায় তার চুলগুলো এলোমেলো হয়ে গেছে... চোখাচোখি হতে সে অপ্রস্তুত হয়ে একটু হাসলো... মেয়েটিও প্রত্যুত্তরে হেসে ঘরের ভেতরে ঢুকে গেল।

মৈনাক ও ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ে... হঠাৎই তার মনে একটা অদ্ভুত অনুভূতি হয়... একটা ভালোলাগার অনুভূতি।

(২)

অফিসের কাজে ব্যস্ত হয়ে যাবার পর সকালের কথা ভুলেই গিয়েছিল, দুপুরে ভাত খেতে খেতে মনে হয়... কে এই মেয়েটা, পাশাপাশি থাকলেও এখানে তো কাউকেই চেনেনা। দেখে তো অবিবাহিত মনে হয়... নিজের ভাবনায় হাসি পায়, এইরকম একা একা থাকতে হলে মাথায় গোলমাল দেখা দেবে মনে হয়।

দুপুরে নিজের ল্যাপটপ নিয়ে বারান্দায় গিয়ে বসে, একবার আড়চোখে পাশের ফ্ল্যাটের বারান্দাটা দেখে,নাহ্ কেউ নেই।

নিজের কাজে মগ্ন হয়ে যায়, হঠাৎ করেই হাসির শব্দে খেয়াল করে তার সুন্দরী পড়শী বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফোনে কারুর সাথে কথা বলছে... মন দিয়ে শুনে বুঝতে পারে হিন্দিতে কথা বলছে।
তবে কি বলছে সেটা বোঝা যাচ্ছে না। আবারও চোখাচোখি হতে দুজনেই সৌজন্য হাসির বিনিময় করে। বিকেলে রান্নাঘরে গিয়ে দেখে কয়েকটি জিনিসপত্র প্রায় শেষ। সামনেই একটা সুপার মার্কেট আছে, কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী তখন তো বন্ধ হয়ে যাবার কথা। ঠিক করে পরদিন সকালে উঠে সেখানে চলে যাবে, কিছু জরুরী জিনিসপত্র গুছিয়ে কিনে আনতে হবে।

পরদিন সকালে উঠে লিফটে ঢোকার সময় চমকে ওঠে, পাশের ফ্ল্যাটের সুন্দরী তার সাথে লিফটে। যদিও মুখে মাস্ক পরা, তবুও চিনতে অসুবিধা হয় না। মৈনাকের মুখেও মাস্ক তবে বোঝা গেল মেয়েটিও চিনতে পেরেছে।

মৈনাক হিন্দিতেই বলল...

“নমস্তে , ম্যাডাম,মেরা নাম মৈনাক চক্রবর্তী, আপকে পড়োশী হুঁ।“

মেয়েটি খুব অবাক হয়ে বললো...

“আরে ,কি কান্ড, আপনি বাঙালি! দারুণ ব্যাপার তো, আমার নাম সুদেষ্ণা রায়। আমি মুম্বাইয়ে চাকরি নিয়ে এসেছি প্রায় দুই বছর হয়ে গেল। আপনার পাশের ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকি। তবে আপনাকে এই প্রথম দেখলাম। আপনি কি এখানে থাকেন না?”

মৈনাক ও যথেষ্ট অবাক,সে বলে...

“ সত্যিই ভীষণ আনন্দ হচ্ছে, আপনি বাঙালি বলে। আসলে এটা আমার এক বন্ধুর ফ্ল্যাট, সে এখন কর্মসূত্রে বিদেশে। আর আমি কর্মসূত্রে কলকাতা থেকে মুম্বাই এসে লকডাউনের ফাঁদে আটকে পড়েছি । এই প্রবাসে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে কতোদিন থাকতে হবে জানিনা। যদিও এখন যা পরিস্থিতি তাতে কারোর সাথে দেখা করা ঠিক নয়। তবুও নিজের বাড়িতে তো থাকতে পারতাম। তবে আপনার সাথে কথা বলে খুব ভালো লাগছে।“

সুদেষ্ণা মৈনাকের কথা শুনে হেসে ফেলে, তারপর দুজন মিলে সোস্যাল ডিসট্যান্সিং মেনেই সুপার মার্কেট থেকে কেনাকাটা সেরে নেয়।

(৩)

বাড়িতে ফিরে আসার পরেও মনে একটা আনন্দের ছোঁয়া লেগে থাকে মৈনাকের। সুদেষ্ণা রায় নামটা শুনে কেমন ভালোলাগা জড়িয়ে ধরে।

খুব ইচ্ছে করছিলো ফোন নম্বরটা চেয়ে নেয়, কিন্তু যদি নির্লজ্জ ভাবে, সেইজন্য চাইতে পারলো না। এখন খুব আফসোস হচ্ছে। মনে হচ্ছে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়, অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে অফিসের কাজকর্ম করতে শুরু করে।

বিকেলে মনে হয় একটু ছাদে উঠে দেখলে হয়, সারাক্ষণ বাড়িতে বন্দি থাকলে শরীর ঠিক রাখা মুস্কিল।একটু হাঁটাচলা করতে হবে। ফ্ল্যাটের ছাদ বিশাল বড়ো ,সে দেখলো অনেকেই সেখানে গিয়ে হাঁটাহাঁটি আর ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ করছে।

 দেখেও ভালো লাগে বেশ স্বাস্থ্য সচেতন লোকজন। নিজেদের মধ্যে দূরত্ব বজায় রেখেছে। তবে হালকা গল্পগুজব ও চলছে। তাকে দেখে সবাই একটু অবাক হয়ে যায়। নতুন লোক ফ্ল্যাটে এসেছে, সেটা তো এখন নিরাপদ নয়।

অনেকেই কৌতুহলী হয়ে প্রশ্ন করে, তবে সেই সময় মুস্কিল আসান হয়ে অবতীর্ণ হয় সুদেষ্ণা। তার সাথে অনেকেরই পরিচয় আছে। সে ই সবাইকে মৈনাকের পরিচয় দেয়। তখন সবাই আস্বস্ত হয় যে একদম অপরিচিত কেউ নয়।

সুদেষ্ণার ব্যবহার তাকে মুগ্ধ করে, মেয়েটা অবশ্য বিন্দাস। খুব মিশুকে স্বভাবের তাই সবার সাথেই বকবক করে। খানিকটা হাঁটাহাঁটি করে ঘাম ঝরানোর পর সে ফিরে আসছিল তখন সুদেষ্ণা বলে...

“মৈনাক পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে যাও, তোমার সাথে কথা আছে।“

মৈনাকের বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করতে থাকে... কি বলবে এই মেয়ে, এখন তো ভালোকরে আলাপ ই হয়নি।

সুদেষ্ণা বলে ...

“আরে বাহ্, দাঁড়িয়ে আছো,গুড বয়... চলো আমার ফ্ল্যাটে একসাথে চা বা কফি খেতে খেতে গল্প করা যাবে।“

মৈনাক বলতে যায়, এখন তো কারো বাড়ি যাওয়া যায় না... কিন্তু সুদেষ্ণার দিকে তাকিয়ে , তাকে মানা করতে পারলো না।

(৪)

কফি খেতে খেতে দুজনের মধ্যে দারুণ আড্ডা শুরু হয়ে গেল... কলকাতার মেয়ে সুদেষ্ণা, ষোলো বছর বয়সে মাকে ক্যান্সারে হারিয়েছে। বাড়িতে বাবা আর ছোট ভাই, ভাই তখন মাত্র বারো বছরের।দশ বছর কেটে গেছে,বাবা তাদের জীবনের সবকিছু... সেই সময়ে তিনি দুই ছেলেমেয়েকে আগলে বড়ো করেছেন। সুদেষ্ণা ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে মুম্বাইয়ে চাকরি নিয়ে এসেছে। বাবার খুব একটা ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু মেয়ের স্বপ্নে কোনো বাধা দেননি।ভাই ডাক্তারি পড়ছে... এখন তাদের পরিবার অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে।

তবে যেকোনো কারণেই হোক, সুদেষ্ণা এতোদিনেও কোনো সিরিয়াস রিলেশনশিপে জড়ায় নি। প্রেম যে একবারও আসেনি তা নয়, কিন্তু তার সবসময়ই মনে হয় কিছু একটা খামতি আছে। হয়তোবা সেটা তার নিজের মধ্যেই আছে...

মৈনাক অবাক হয়ে যায়,কি অদ্ভুত এই মেয়ে, প্রথম আলাপেই এতো খোলামেলা... এমন মেয়ে সে আজ পর্যন্ত সত্যি দেখেনি। চিরকাল দেখেছে মেয়েদের মনে যেন জিলিপির প্যাঁচ , সেই জন্যই তার জীবনেও তিন তিনটি প্রেমের সম্পর্ক ভেঙে গেছে।

মৈনাক ও সুদেষ্ণাকে তার সব কথা খুলে বলে... সে তার বাবা, মায়ের একমাত্র সন্তান। কাস্টিং পাশ করে একটা বেশ ভালো বেসরকারি কোম্পানীতে চাকরি করে। কাজের জন্য মাঝে মাঝে মুম্বাই আসতে হয়।তার জীবনের প্রেমের গল্প শুনে সুদেষ্ণা খুব হাসতে থাকে।

গল্প করতে করতে কিভাবে সময় পার হয়ে গেছে তারা বুঝতেই তারা কখন তুই তোকারি করতে শুরু করে দিয়েছে। হঠাৎ করেই খেয়াল হয় যে রাত নটা বাজে, সুদেষ্ণা তখন মৈনাককে রাতে খাওয়ার পর যেতে বলে...

“মেনু কিন্তু খুব সাধারণ, খিচুড়ি আর ডিমের অমলেট, চলবে তো?”

মৈনাক এবারেও মানা করতে পারে না, আসলে এই কয়েক ঘন্টার মধ্যেই সে বুঝতে পেরেছে এমন স্বচ্ছ মনের মেয়ে আজকের দিনে দুর্লভ। নাহলে এতো সহজে নিজের জীবনের সব কথা একদম অপরিচিত কাউকে খুলে বলা অসম্ভব।
মৈনাক বলে..

“চলবে মানে দৌড়বে । দেখ, আমি রাজি কিন্তু একটা শর্ত আছে, রান্নার কাজে আমাকে সাহায্য করতে দিতে হবে।“

সুদেষ্ণা হাসতে হাসতে রাজি হয়ে যায়।

(৫)

রাতে নিজের ঘরে ফিরে, ঘুম আসতে চায় না, সুদেষ্ণার ব্যবহার, তার কথাবার্তা কেমন যেন আচ্ছন্ন করে রেখেছে তাকে। সুদেষ্ণা তার থেকে দুবছরের ছোট হলেও তাদের মধ্যে বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেছে, কথা বলতে বলতে মনে হয় যেন কতোদিনের চেনা।

কিন্তু একটা বিষয় ভেবে অবাক লাগে,এই মেয়ে বন্ধুত্ব যেমন সহজে গড়ে তুলতে পারে, অন্যান্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে বোধহয় ততটা সহজ নয়। প্রথমে তার মনে যে একটা ভালোলাগার ছোঁয়া লেগেছিল, এখন ভালভাবে পরিচয়ের পর সেই ভাবটা খানিকটা কমে গেছে। তবুও এই লকডাউনের সময়ে একজন বন্ধু পাওয়াটাই বা কম কি।
পরদিন সকালে ফ্রেশ হয়ে নিয়ে মোবাইলে হোয়াটসঅ্যাপ এ দেখে সুদেষ্ণা খুব সুন্দর একটা গুডমর্নিং মেসেজ দিয়েছে। মৈনাকের আবার এসব আসে না।সে লেখে ‘সুপ্রভাত, দিনটা ভালো কাটুক।‘

শুরু হয়ে যায় দৈনন্দিন ব্যস্ততা। মাকে ফোন করে বাড়ির সব খবর নিয়ে নেয়। তবে খেয়াল করে তার আর তেমন খারাপ লাগছে না। মনে হচ্ছে না এই লকডাউনের সময়ে সে কিভাবে দিন কাটাবে... অবশ্যই সেটা সুদেষ্ণার জন্য।

কাজের ফাঁকে একবার সুদেষ্ণার সাথে গল্প করে নেয়, মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে যায়।
বিকেলে ছাদে হাঁটাহাঁটি করতে গিয়ে দুজনের আড্ডা হয় বেশ কিছুক্ষণ, তবে আজকে আর সুদেষ্ণার বাড়িতে যায়না, সুদেষ্ণাও হয়তো ডাকতে গিয়েও থেমে যায়, কারণ যতোই হোক রোজ রোজ এটা বোধহয় ঠিক নয়।

সন্ধ্যায় বড়ো একলা লাগে মৈনাকের, একটুখানি অভিমান হয়,ডাকলেই তো পারতো,কি সুন্দর ছিল গতকালের সন্ধ্যার আড্ডা। তারপর ভাবে সত্যিই তো... কি এমন পরিচয়, এভাবে কি রোজ কারোর বাড়িতে যাওয়া যায়।

রাতে খেতেও ইচ্ছে করে না... মনটা কেমন চঞ্চল হয়ে যায়। সুদেষ্ণা কি অ্যাভয়েড করছে তাকে। রাতটা বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে করতে পার হয়ে যায়।

(৬)

পরের দিন সকালে উঠে সুদেষ্ণার গুড মর্নিং মেসেজ টা দেখে মনটা শান্ত হয়ে যায়। রাতে ঘুম না হওয়াতে একটা অস্বস্তি লাগছিল , চা করতে যাচ্ছে এমন সময় কলিংবেল বেজে ওঠে...

দরজা খুলে হতবাক হয়ে যায়, সুদেষ্ণা দাঁড়িয়ে আছে, মুখে একগাল হাসি।হাতে একটা ক্যাসারোল, বলে...

“সকালে ঘুম থেকে উঠে খুব খিদে পেয়ে গেল,গরম গরম আলুর পরোটা বানাতে গিয়ে তোর কথা মনে হলো। তুই কি আর ঘুম থেকে উঠে রান্না করবি... নিশ্চই দুধ, কর্নফ্লেক্স জাতীয় কিছু খেয়ে নিয়ে কাজ চালিয়ে নিবি। তাই আমি চলে এলাম।কি রে বাবা,হাঁদার মতো দাঁড়িয়ে না থেকে আমাকে বাড়িতে ঢুকতে দিবি তো।“

মেয়ে তো নয়, যেন ঝড়... মৈনাক তাকে ঘরের ভেতরে বসিয়ে চা বানিয়ে নিয়ে আসে।দুজনে মিলে চা আর আলুর পরোটা খেতে খেতে গল্প করে। আজকে শনিবার দুজনেরই অফিসের ছুটি।কাজেই সময় হাতে অপর্যাপ্ত।

সুদেষ্ণা বলে...

“তুই কিন্তু অন্যান্য ছেলেদের থেকে বেশি কাজের, বাড়িঘর তো ভালোই পরিস্কার করে রেখেছিস। রান্নাও করতে পারিস। তোর বৌ কিন্তু খুব খুশি হবে। আমি ভাবতাম শুধু আমার বাবা আর ভাই সবরকম কাজ করতে পারে। তুই আমার ভুল ভেঙে দিলি।“

মৈনাক মুচকি হেসে বলে...

“আসলে আমি মায়ের সাথে কাজ করতে করতে সবকিছু শিখে গেছি, বাবা বলেন ছেলেদের সব কাজ শিখে রাখা ভালো, কর্মসূত্রে কোথায় যেতে হবে তার ঠিক নেই, সেখানে যদি কোনো ব্যবস্থা না থাকে, তাহলে নিজেরটুকু অন্ততপক্ষে চালিয়ে নিতে পারবে।“

সুদেষ্ণা বলে ...

“জানিস ,কাল থেকে আমার মনে হচ্ছে এই লকডাউনের সময়টা তোর সাথে আড্ডা মেরে, রান্না খাওয়া করে ভালোই কাটবে। কিন্তু এরপর সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে গেলে তুইতো ফিরে যাবি। আমি আবার সেই একা। তারপর মনে হলো, তাতে কি হয়েছে তখনকার কথা চিন্তা করে এখনকার মজাটা মাটি করি কেন।এই সময়ে এটা তো বিশাল বড়ো পাওয়া।“

মৈনাক আবারও ভীষণ অবাক হয়ে যায়,এই মেয়েটা সত্যিই ভীষণ অন্যরকম।

(৭)

এভাবেই বেশ আনন্দে , গল্পে কেটে যাচ্ছিল দিনগুলো । মৈনাকের মনে সুদেষ্ণার প্রতি একটা বিচিত্র আকর্ষণ বোধ জাগ্রত হয়েছিল... কিন্তু সে বুঝতে পারে না সেটা কি... প্রেম নাকি অন্যকিছু।এর আগের প্রেমের সম্পর্ক গুলোর সাথে এর কোনো মিল নেই। তাছাড়া সুদেষ্ণার মনে কি আছে সেটা বুঝতে পারেনা একদমই। এই মেয়েটা প্রেম ছাড়া সবকিছুতেই সাবলীল।

দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব যতো গভীর হয়,ততোই মনে হয় লকডাউন শেষ হয়ে যাবার পরেও  কি এই সম্পর্কটা এভাবেই থাকবে...

একদিন টিভি দেখে জানতে পারে লকডাউন ধীরে ধীরে শিথিল করা হচ্ছে, এবার বিমানযাত্রা শুরু হয়ে যাবে। কেন জানিনা এই খবর শোনার পর সুদেষ্ণা খুব গম্ভীর হয়ে যায়।

তারপর নিজের থেকেই বলে...

“ সত্যিই তো আমাদের গরীব দেশে আর কতোদিন এভাবে সবকিছু বন্ধ করে রাখা সম্ভব। পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্গতি দেখে চোখে জল এসে যায়।তার ওপর প্রাকৃতিক দুর্যোগ। চারিদিকে শুধু নৈরাশ্যের ছবি।আমরা দুজনেই তো সাধ্যমত ত্রাণ তহবিলে অর্থ পাঠালাম, কিন্তু সব অভাব কি এভাবে মেটানো সম্ভব... বহু মানুষের কাজ নেই। 

যাইহোক এসব কথা থাক... তুই ও নিশ্চই নিজের পরিবারকে মিস করছিস। এতো দিন ধরে আমার পাগলামি সহ্য করতে হচ্ছে,এটা কি কম ঝামেলা। কলকাতায় ফিরে আমাকে যেন ভুলে যাস না। রোজ না হলেও মাঝে মাঝে ফোন করে কথা বলিস। আমি তো এখানে একাই থাকবো, তুই চলে গেলে আরোও ফাঁকা ফাঁকা লাগবে।“

সুদেষ্ণার অকপট স্বীকারোক্তি শুনে মৈনাকের বুকের ভেতর একটা চিনচিনে ব্যাথার অনুভূতি হতে থাকে। সুদেষ্ণা যদি না থাকতো তাহলে এই লকডাউনের সময়ে প্রবাসে তার সময় যে কিভাবে কাটতো... মেয়েটা এই কঠিন সময়টাকে আনন্দে ভরিয়ে দিয়েছে, কেমন ভাবে যেন তার মনের গভীরে নিজের জায়গা তৈরি করে নিয়েছে... হঠাৎ করেই তাকে ছেড়ে থাকার কথা ভাবলেই কেমন যেন অদ্ভুত কষ্ট হচ্ছে।

তারা দুজনে একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকে... কিছু বলতে পারে না।

(৮)

রাতে মৈনাক ঘুমোতে পারে না, খালি মনে হয়... সুদেষ্ণার সাথে কথা বলতে হবে । ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত প্রায় আড়াইটা বাজে । এমন সময় কোনো মেয়েকে ফোন করা উচিত নয়, কিন্তু নিজের মনকে কিছুতেই শান্ত করতে না পেরে , ওই সময়েই সুদেষ্ণাকে ফোন করে, অবাক কান্ড সুদেষ্ণা বুঝি তার ফোনের অপেক্ষাতেই ছিল,সে মুহূর্তের মধ্যেই ফোনটা ধরে...

মৈনাক বলে...

 “ সুদেষ্ণা, আমার মনে ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে, বিশ্বাস কর আমি হয়তো ঠিক তোকে বোঝাতে পারব না, লকডাউন যখন শুরু হয়, তখন বাড়িতে ফিরে যাওয়ার জন্য আমি যতোটা ব্যগ্র ছিলাম। এখন ঠিক তার উল্টো ... আমার একদম ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে না। কেন জানিস... তোকে ছেড়ে থাকার কথা ভাবলেই কেমন যেন লাগছে। তুই কি আমাকে পাগল ভাবছিস?”

সুদেষ্ণা কিছুক্ষণ চুপ থেকে তারপর বলে...

“ তুই এখন আমার ফ্ল্যাটে আসতে পারবি... অবশ্যই আমাকে যেন ভুল বুঝিস না। কোনো মেয়ে এভাবে একজন ছেলেকে রাতে তার ফ্ল্যাটে ডেকে পাঠালে তার সম্বন্ধে খুব খারাপ ধারণা হওয়াই স্বাভাবিক। তবে আশাকরি তুই আমাকে চিনিস, তাই বললাম চলে আয়। সামনাসামনি কথা বলতে হবে।“

মৈনাক একটুখানি অবাক হয়ে গেলেও সে ভাবে,এই জন্যই তো সুদেষ্ণা সবার থেকে আলাদা,সে এককথায় রাজি হয়ে বেরিয়ে পড়ে।
মনের কথাটা মুখে নিয়ে আসাটা অনেক সময় ভীষণ কঠিন হয়ে যায়, তবুও সে সবটুকু সাহস সঞ্চয় করে নিয়ে সুদেষ্ণার ফ্ল্যাটের বেশ বাজায়।আজ তাকে বলতেই হবে।

(৯)

সুদেষ্ণার সামনে দাঁড়িয়ে কেমন যেন নার্ভাস হয়ে পড়ে মৈনাক। সুদেষ্ণা কিন্তু বেশ সাবলীল ভাবেই তাকে বসিয়ে একটা কফির কাপ এগিয়ে দেয়। তারপর বলে...

“ তুই যে ভীষণ ডিস্টার্বড হয়ে আছিস বুঝতে পারছি। তোকে প্রথমবার এতোটা চঞ্চল দেখলাম। নাহলে আমি তো বুঝতেই পারছিলাম না তোর মনের ভেতর কি চলছে। তোর ফোনটা পেয়ে বুঝলাম রাতটা আমি একাই জেগে নেই... এবার তোর পালা।“

মৈনাক সুদেষ্ণার কথায় হেসে ফেলে... সত্যি এই মেয়েটা সবকিছু এতো সহজ করে দেয়...সে বলে.…

“এতোই যখন বুঝদার তাহলে এটা তো জানিসই,এই মাঝরাতে আমি কি জন্য এসেছি... তবুও আমি নিজের মুখেই বলতে চাই... আমার আঠাশ বছরের জীবনে আমি অনেক মেয়ে দেখেছি, কিছু মেয়ের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ও তৈরি হয়েছে, কিন্তু যেকোনো কারণেই হোক সেটা ভেঙে গেছে। তবে আমি এখন ভীষণ খুশি, সেই ঘটনাগুলো ঘটেছে বলে আমি তোকে কাছে পেয়েছি। তুই এমন একটা মেয়ে যাকে বন্ধু হিসেবে পাওয়া সত্যিই ভীষণ বড়ো প্রাপ্তি। কিন্তু আমি এই বন্ধুকে আমার আরও অনেক বেশি কাছে পেতে চাই। আমি তোকে আমার সহধর্মিণী রূপে পেয়ে ধন্য হয়ে চাই। এবার তুই বল... জানি খুব নাটকীয় লাগছে তবুও তুই বল।“

সুদেষ্ণার মুখে একটা লজ্জার ভাব ফুটে ওঠে... মৈনাক যেটা দেখে ভীষণ স্বস্তি অনুভব করে...

তবে খুব তাড়াতাড়িই নিজেকে সামলে নিয়ে সে বলে...

“দেখ, এখনও সময় আছে , চাইলে নিজের মত বদলাতে পারিস। আমি যদি একবার হ্যাঁ বলে দিই তাহলে কিন্তু বেতালের মতো সারাজীবন ধরে ঘাড়ে নিয়ে ঘুরতে হবে।বিক্রম-বেতালের জোড়ি কিন্তু ভাঙা যাবেনা।“

মৈনাক সুদেষ্ণার কথায় হেসে , তার হাত ধরে নিজের বুকে টেনে নেয়... বলে...

“আমি সারাজীবন এই সম্পর্কে জড়িয়ে থাকতে চাই,শুধু তুই আমার সাথে থাকিস।“

সুদেষ্ণা পরম নির্ভরতায় তার বুকে মাথা রেখে বলে...
” তথাস্তু “

Post a Comment

0 Comments