শেষ অংশ | Bengali short romantic story


কলমে: দিব্যেন্দু সরকার।     
        
"পালাচ্ছো? দেবদত্ত সরকার।"
 "অনন্যা, তুমি খুশি তো?" দেবদত্ত বেশ বিশ্বাসের সঙ্গে প্রশ্ন করলো।
--"কি শুনতে চাও?"
--"দেখো অনন্যা, একটা সম্পর্ক অনেক সময় পেলে তার মধ্যে থেকে শাঁস বের করে শুধু শেষের অপেক্ষা-টা জিইয়ে রাখে।"
অনন্যা, একবার তাকালো দেবদত্তের দিকে, "তার মধ্যে নতুন কিছু থাকে না, তাই তো দেবদত্ত সরকার।"
দেবদত্ত: আমি জানি তুমি খুশি অনন্যা। আর আমাদের সম্পর্ক বলছো? তোমার আর গোয়েল এর সম্পর্ক-টা আমাদের সম্পর্কের মধ্যে সমান্তরালে কি চলছিলো না?
অনন্যা কিছু বলার বা উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করলো না। একবার ঘড়ি-র দিকে দেখলো, এই মুহূর্তে করোনা ভাইরাস আতঙ্কে জর্জরিত সবাই, ভীষণ ভাবে ছড়িয়ে যাচ্ছে রোগ, তাই মা একটু বেশি চিন্তা করে। নাহ, দেবু, রাত সাত-টা বাজে, আমি যাচ্ছি, এটা সঠিক সময় না।
অনন্যা অনেকটা দূরত্ব বজায় রাখছে। বারবার গ্লাভস-হাত মুখটা চেপে রাখছে,  প্রথমেই খেয়াল করেছে দেবদত্ত,-"আমার সঙ্গেও খুব ফর্মালিটিস করছিস দেখছি, ভালো। আমাদের মধ্যের দূরত্ব থাকাই ভালো" একটা তাচ্ছিল্যের হাসি নিয়ে দেবদত্ত অনন্যাকে বললো।
অনন্যা যেনো প্রত্যাশাই করেছিলো তাই স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর দিলো,-"দেবু, আমি অনেক জায়গায় যাই, অনেকের কাছে আসতে হয়, এটুকু দায়িত্ববোধ এই সময় আশা করা উচিত। এখন বাড়িতেও অনেকটা দূরত্ব বজায় রাখছি, বলতে পারিস হোমেকরেন্টাইন। "বলে অনেক্ষন হাসলো অনন্যা।
দেবদত্ত এটাও দেখেছে,অনন্যা খুব আসতে আসতে চেপে-চেপে কথা বলছে, কথা বলতে খুব একটা ইচ্ছে যে অনন্যার নেই সেটা বারবার বুঝিয়েছে, তাহলে অযথা ওঁ নিজেই দেবদত্তকে ডাকতে গেলো কেনো ? আর ডাকলোই যখন তখন শিবমন্দিরে কেনো মিট করলোনা? কেনো এতো দূরে আসলো?

অনন্যা বলেছিলো আজকে  কথা বলা জরুরি ছিলো তাই দেবদত্তকে অনন্যা  ডেকেছিলো, জোর-টা চিরতরেই হালকা করার জন্যই আজকের জোর গুরুত্বপূর্ণ ছিলো দেবদত্তের জানে ভালো করে। অনন্যা বেশিক্ষন দেবদত্তের সঙ্গে থাকতে পছন্দ করবেন  না এটা ভালো করেই  বোঝে দেবদত্ত। 
দু-মাস আগেও সন্ধ্যে সাতটা এতো রাত মনে হতোনা অনন্যার, অথচো আজকে?
খুব তাড়াতাড়ি হঠ করে সমাধান হয়ে গেলো। দেবদত্ত জানতো। সে জানতো অনন্যা আর একজনকে ভালোবাসে, একটা অভ্যেস দু-জনের মধ্যে ছিলো, তাই পাশাপাশি হাটছিলো গত এক বছর থেকে, শেষ তিন মাস খুব তাড়াতাড়ি কেটে গেলো, আর দেবদত্ত জানে ওঁদের আর বড়জোর দিন পনেরো একসাথে হাটতে হবে। অনন্যা বাড়ীমুখি হয়ে গেছিলো, স্কুটি নিয়ে এসেছিলো অনন্যা। অনন্যা কেনো ডেকেছিলো? ভাবতে ভাবতে দেবদত্ত বেশ কিছুক্ষন ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলো দেবদত্ত। এই মুহূর্তে ভাইরাস আক্রমণের জন্যে লোক কম। অযথা কেনো দাঁড়িয়ে আছে?  তার কোনো সঠিক উত্তর বুঝতে পারেনি, এবার আর দাঁড়ালোনা, পৌনে আট -টা বাজে এখন, ঘড়িটা একবার দেখলো।

যতো দিন যাচ্ছে ছেলেদের মধ্যে বাজে একটা ঔদ্ধত্বতা দেখা যাচ্ছে, এটা আগে ছিলোনা এমন নয়,  কিন্তু এখন যেনো কেমন একটা লাগে, আগে এর থেকে বেশি রাতেও অনন্যা ফিরেছে বাড়ীর সামনের রাস্তা ধরে, বরং আজকে তো মাত্র আট  বাজে, আজ থেকে তিন-চার বছর আগেও  সে রাত দশ-টার সময়ও  ফিরেছে কিন্তু তখন আর যাই হোক ভয় লাগতো-না, আজকাল কেমন যেনো একটা ভয়-ভয় লাগে।
মায়েরাও এটা অনুভব করেছে তাই ভয় পায়। আর সত্যি অনন্যা ভয় পাচ্ছে রাস্তার ধারে দেওয়াল ধরে আড্ডা দেওয়া ছেলেদের জন্যে। যখন "করোনা"র জন্য কেউ একসাথে থাকতে চায় না, তখনও এরা আড্ডা দেয়, আর প্রশাসনও চুপ, অবশ্য কাকে ধরবে কাকে ছাড়বে?
প্রায় দৌড়োতে-দৌড়োতে বাড়ি ঢুকলো অনন্যা, দরজা খোলাই ছিলো, বুঝলো মা রান্না ঘরে নিশ্চই, আর 
বাবা, ভাই কেউ ঘরে নেই। অনন্যা আসলে জানে বাড়ী  সাধারণত এই সময় কেমন থাকে তাই অনুমান যে মিলবে জানতো। রাস্তার জীবন পালটে গেছে, আজকাল বাইরের জগৎকে ভয় লাগে, অসভ্যতা- হিংস্রতা বেড়ে গেছে, এদিকে আবার দরজা খোলা। মা, অনেকটা ভেতরে- একা রান্নাঘরে, যেনো আজকাল আর ভয় নেই। 
কথাটা ভেবে হাসতে-হাসতে বললো, "মা', বাবা, ভাই নেই?"
"বাবা ওষুধ আনতে গেছে আর ভাই কি শোনে কোনো কথা, পুলিশ ধরলে বুঝবে।"  মা' যেভাবে রান্না করছিলো সে ভাবেই উত্তর দিলো।
অনন্যা জানে বাবা কোনো-না কোনো অজুহাতে বের হবেই আর ভাই তো আঠেরো বছর, তাই স্পর্ধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি। হাসতে-হাসতে অনন্যা তিনতলায় নিজের ঘরের দিকে চলে গেলো,নিজের ঘরেই নিজের বাথরুম রয়েছে। 
বাবা স্কুল মাস্টার হলেও শুধু স্কুলের মধ্যে সীমাবদ্ধ নিজেকে রাখেননি, উনি নাটক দলের প্রধান ছিলেন, আজকেও যুক্ত রয়েছেন তবে হেল্প করে থাকেন, এছাড়া বাবা একটু রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন, বাবা বলতেন ভালো লোকের সেখানে অভাব হচ্ছে, অনন্যা বাবার কথা ভেবে হাসলো। বাবা অবসর নিয়েছেন স্কুল জীবন থেকে বোঝাই যায়না যে ভাবে উনি জীবন যাপন করছিলেন, এখন চারদিকের অবস্থায় একটু সামলে নিচ্ছেন।
আর ভাই শিলিগুঁড়িতেই ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে সবে ভর্তি হয়েছে। আর অনন্যার মা' বাড়ীর যে যা করছে তা করতে পারছে ওনার জন্যই।
অনন্যা নিজে গার্লস স্কুলের লাইফ সাইন্সের শিক্ষিকা, মাস্টার ডিগ্রী পাশ করে এক বছর পরে চাকরিটা পেয়েছিলো। অনন্যার বরাবরের ইচ্ছে ছিলো বাবার মতন ছাত্র-ছাত্রী তৈরী করবে।
পরিবারের সবাইকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে ফ্রেশ হয়ে নিলো অনন্যা। 


দেবদত্ত কেন রাগ করেনি বা খারাপ পায়নি? যখন ও বুঝতে পেরেছিলো অনন্যা অন্য কারো সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছে। 
দেবদত্ত কি কোনো কমিটমেন্টের থেকে কিছুটা হালকা অনুভব করছিলো?
অনন্যা ভুল যে করছিলোনা দেবদত্ত জানতো, বছর খানেক ধরে সে ,সম্পর্কের মধ্যে ছিলোই না।
যেটা চলছিলো তা হলো দুজনের মধ্যে অলিখিতো একটি লিখিতো বোঝাপড়া।
তাই দুজনেই বোধহয় খুশি ছিলো যা হচ্ছিলো তাতে।
দেবদত্ত এখন তাড়াতাড়ি বাড়ি ঢোকে না, দেরী করে যায় বাড়ীতে , বেশিরভাগ দিন রাতে একবার ঢুঁ-দেয় অরিন্দমের বাড়ী । অরিন্দম এমনিতে দোকান বন্ধ করে মোটামোটি দশ- সাড়ে দশটা নাগাদ, তারপর একটা বোতল আর গ্লাস নিয়ে নিজের ঘরে বসে, এখন সন্ধ্যে ছয়টার পর আর খদ্দের আসবেই না, তাই অরিন্দমও অপেক্ষা করে দেবদত্ত আসার। আগে রাত দশটার পর অরিন্দমের সাথে  তাঁর মা-বাবার  সে দিনের মতো আর দেখা সাক্ষাৎ হতোনা, আজকাল ছয়টার পর একটু সবার সাথে সময় কাটায়।

"না, তাহলে ভাই তুই করবি কি?  মানে, কি ভাবছিস এরপর।" গ্লাসে মুখ রাখতে-রাখতে দেবদত্ত-কে জিজ্ঞেস করলো অরিন্দম।
"দেবদত্ত: ধূর।  জানি-না, সব ফালতু। মিনিংলেস। যা করছি, যা দেখছি সবটা অভিনয়, একটা সাজানো।"
অরিন্দম: "বুঝলাম। তো?"
দেবদত্ত: "বের হতে হবে। ঘেন্না ধরে গেছে।"
অরিন্দম: "কার ওপর ঘেন্না ধরলো?"
দেবদত্ত: "কার ওপর না?  সবকিছুর ওপর, সমাজের ওপর, জীবনের ওপর, কে ঠিক বলতো?  সব নেতা খাচ্ছে, শেষ করে দিচ্ছে বেঁচে থাকার প্রয়োজন-গুলোকে, একটা শিক্ষক আজকে  শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা রাখে, প্রত্যেকের একটাই উদ্দেশ্য, বেচু হয়ে গেছে সমাজ।
সব শালা বেচু, বিক্রি করছে কেউ নিজেকে।  কেউ দেশ-কে।" 
আজকে একটু বেশি উত্তেজিতো দেখাচ্ছে দেবদত্ত-কে।  অন্যদিন বলে, কিন্তু সেটা আলোচনা হয়, আজকে আর আলোচনা হবে না, দেবদত্তের ঘেন্না অনেক বেশি বেড়ে আছে বুঝলো অরিন্দম।
"এই সময় চলে গেলে, মা,বাবা,দাদা,বৌদি, ভেবেছিস?" কৌতূহল চোখে অরিন্দম জানতে চাইলো।
দেবদত্তের আর কথা বাড়াতে ইচ্ছে করলোনা, "উঠি বুঝলি," বলে দেবদত্ত উঠতে যাচ্ছিলো, অরিন্দম বাধা দিয়ে বললো, "আরে সবে তো সোয়া দশটা  বাজে, এগারোটা পর্যন্ত থাক।" 
"না,ভাই আজকে যাই।" আর ভালো লাগছিলোনা তাই আর কোনো কথা না বলে অরিন্দমের বাড়ী  থেকে বেরিয়ে এলো দেবদত্ত।
যতো রাত বাড়ে, পৃথিবীটাকে যেনো চেনা লাগে, হাটতে ভালো লাগে। চারপাশ-টা দেখলে মনে হয় কেমন যেনো সব থমকে গেছে, কে যেনো ক্ষমা চেয়ে বেড়াচ্ছে চারপাশে।
আচ্ছা একটা সময় গিয়ে মানুষের একা থাকতে বেশি ভালো লাগে কেনো? একার সাথেই যেনো বেশি পরিচয়,  রাতে এইভাবে অনেক কিছু নিয়ে ভাবতে-ভাবতে হাটতে ভালো লাগে দেবদত্তের। অনেক কিছুর সমাধান সে পেয়েছে এতো রাতে একা হাঁটার সময়। কয়েকদিন ধরে অনন্যা কে নিয়ে ভেবেছে। না-অনন্যার ওপর রাগ বা ক্ষোভ থাকার কথা তাঁর না, কারণ ভুলটা তাঁর ছিলো সেটা দেবদত্ত জানে তাই বারবার সে নিজেকেই সেটা বুঝিয়েছে আর তাছাড়াও অনন্যার কাছ থেকে অন্য কিছু আশাও দেবদত্ত করেনি।
কেমন যেনো একটা সমাধান পেয়েছে দেবদত্ত, আর কোনো দায়িত্ব থাকছেনা, এবার বেরিয়ে পড়া যাবে। শেষ কথাটায় একটা পরিতৃপ্তি নিয়ে বাড়ীর  দিকে তাকালো দেবদত্ত, তিনতলা বাড়ি, দাদা-বৌদি রা এখন বাড়িতেই আছে, বাঙ্গালোর থেকে ঠিক সময় দাদা আর বৌদি এসে গিয়েছিলো ভাইজি আর ভাইপো কে নিয়ে। এগারোটা বাজে, এই সময় সবাই জেগেই আছে জানে দেবদত্ত। 
বাড়ীর  দিকে তাকিয়ে একটা গল্পের মতো মনে হয় দেবদত্তের, এই দৃশ্য যেনো আগেই হয়ে গিয়েছিলো,  দেবদত্ত আবছা আলোতে পরিষ্কার দেখছে সে নিজেই যেনো সামনে দাঁড়িয়ে, কোনো এক জায়গা থেকে সে এসে দাঁড়িয়েছে ঠিক যেমন দেবদত্ত এখন দাঁড়িয়ে। সামনের লোকটি পকেট থেকে চাবি বের করলো, এতে তো সে নিজেও অভ্যস্ত, বাড়ীর একটি চাবি নিজের কাছেই রাখে যাতে কাউকে ডেকে কষ্ট দিতে না হয়, সামনের লোকটির মতন দেবদত্তও  ঠিক সেভাবেই চাবি বের করলো। আসতে আসতে গেট খুলে আবার লাগিয়ে লোকটিকে অনুসরণ করতে করতে পৌঁছে গেলো বাড়ীর ভেতরে। ভেতরে ঢুকতেই ভাইজি ছুটে এলো দেবদত্তকে ধরতে। হঠাৎ ভাইজি আসায় দেবদত্ত সাবধান হয়ে গেলো কারণ সে বাইরে থেকে এসেছে। ভাইজিকে সামলে অনেক খুঁজলো সেই লোকটিকে কিন্তু আর পেলোনা খুঁজে।


"হ্যা, এই খেলাম, বলো।" অনন্যা এমন ভাবে বিছানায় শরীর ফেলে গোয়েল-কে ফোন-এ জানালো যেনো একটা বড়ো যুদ্ধ করে সে একটু বিছানা পেলো।
গোয়েল: "আজকেও নিজের ঘরেই খেলে?"
অনন্যা: "ভালো লাগছেনা কয়েকদিন ধরে, মনটা খারাপ,  তাই ঘরেই খাই আজকাল।"
গোয়েল: "কত-বার তোমাকে ফোন করলাম, ধরলেই না- তোমার তো.....".
গোয়েল এর জন্ম শিলিগুঁড়িতেই কিন্তু বাংলা যেভাবে বলে আর অনেক শব্দ খুঁজে পায়না, তখন  কথাটা পুরো বলতে পারেনা, অনন্যার এটা বেশ লাগে। হাসতে-হাসতে অনন্যা বললো, "গোয়েল জী রাতে  আপনার সাথে কথা বলছি এর থেকে বেশি কি?" বলে এবার একটু জোরেই হাসলো অনন্যা।
"তারপর বলো।" ক্ষীণ স্বরে বললো অনন্যা।
গোয়েল ও একটু হাসলো, "আজকে একটা ভালো বিজ্নেস হলো। "করোনা ভাইরাস" একটা বিজ্নেস দিলো, মেডিক্যাল-এর সব আমরা দেবো পুরো নর্থবেঙ্গলে।" অনন্যা কে জানিয়ে গোয়েল একটু জোরে হাসলো। 
অনন্যা এবারে বেশ মন দিলো শোনাতে, আজকাল ব্যাবসা-টা বোঝার চেষ্টা করছে, শুনতে ভালো লাগে।
অনন্যা মাঝে-মধ্যেই গোয়েল-কে থামিয়ে, মার্জিন, এটা -সেটা আরো ভালো করে বোঝার চেষ্টা করে। যেদিন কথা হয় সেদিন দু-একটা কথার পরে বিজ্নেস এর গল্প এসে যায় আর অনন্যা একই রকম ক্যালকুলেশন বুঝতে অনেক রাত করে দেয়।


সকাল বেলা সব কিছুর চরিত্র মূলত একই থাকে, চরিত্র-টা সময়ের সাথে সাথে বদলাতে থাকে, মধ্যগগনে যখন সূর্য তখন সব কিছুর চরিত্র একদম বদলে যায়, রুক্ষতা বেরিয়ে আসে, চারপাশের মানুষ-গুলোকে বিরক্তকর বলে মনে হয় দেবদত্তের।
রবিবারের সকাল, নিয়মাফিক মাংস নিয়ে আসা, বাজার, আর যা-যা কাজ থাকে করে ফ্রেশ হয়ে নিজের ঘরে বসলো মাত্র দেবদত্ত। খুব সকালে বাজার বসে বড়ো মাঠে, যাতে অন্যের সাথে দূরত্ব থাকে।  খুব সাবধানে চলতে হয়, তাই বাড়ি এসে ভালো করে স্নান করে নিয়েছে। দু-চার বার ভাইজি ঐনি এসে ঢুঁ-দিয়ে গেছে ঘরে, নয় বছর বয়েস, আর ভাইপোর বয়েস ছয় বছর, ভাইপো নিজেতেই নিজে ব্যস্ত থাকে তাই কাকার ওপরে তেমন দাবি রাখেনা। দাদা সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, অনেক বছর ধরে ব্যাঙ্গালোরে থাকছে, বৌদি বাড়ীর দায়ীত্ব নিয়েছে। দেবদত্তের বাবা শান্ত মানুষ, বিশবিদ্যালয় এর  কর্মচারী জীবনে সন্তুষ্ট। মা, বাড়ীর দায়িত্ত্ব নিপুন ভাবে পালন করে চলেছেন।
সকাল থেকেই আশীষের ফোন আসবে বলে  অস্থির হয়ে আছে দেবদত্ত।
নয়টা দশ  বাজে, ফোন আসবে না ওই করবে একটু চিন্তা করে নিয়ে দেবদত্তই ফোন করলো আশীষ-কে।
আশীষ: "হ্যালো, হ্যা, বল -কি করছিস?"
দেবদত্ত: "আরে তোকে বলেছিলাম, তুই আজকে জানাবি বলেছিলি।"
আশীষ: "ওহ, হ্যা- আরে, এরমধ্যে বলবার আর কি ছিলো, ভাড়া চলে গেছে, তুই আরাম্সে  থাকতে পারবি। কিন্তু তুই এই সময় ওখানে জাবি কেনো?"
দেবদত্ত: "একটা মাস একটু একা থাকতে চাই, তাই সেদিন তোর কাছে ভাড়া চলে গেছে , বাড়ী  ফাঁকা হচ্ছে জেনে মনে হলো তোদের চালসার বাড়ীতে থাকা আমার জন্য সবচেয়ে ভালো হবে।" 
আশীষ: "নিজে গাড়ি রিজার্ভ নিয়ে যেতে পারবি আর খাট,রান্নার ব্যবস্থা, থাকছেই। তোর  চাকরি? যদিও চাকরি এখন তো  বন্ধই আছে নিশ্চই।"
দেবদত্ত: "কোম্পানী ছেড়ে দিয়েছি।" 
আশীষ: "সে কি-রে?"
দেবদত্ত: "আশীষ, বলা হয়নি , আমার জার্মানির -একটা কোম্পানি-তে হয়েছে। ওরা ভালো টাকা, সুবিধে দিচ্ছে। এখন ঘর থেকেই ওন -লাইন কাজ হবে , এরপর সব ঠিক হলে চলে যেতে হবে। ঠিক করলাম চলে যাবো। আমার ইলেকট্রনিক্স এর ওপরে জ্ঞানের প্রকাশ হোক।"
আশীষ: "শালা, এতো বড়ো খবর, তুই চলে যাচ্ছিস, বন্ধুরা কেউ জানে?" 
দেবদত্ত: "না, তোকেই প্রথম বললাম। এখন বের কে আর হচ্ছে?"
আশীষ: "ফোনে তো বলতেই পারিস। অনন্যা জানে? আচ্ছা অনন্যার সঙ্গে একটা মাড়োয়াড়ি ছেলেকে মাঝেমধ্যে দেখি, কে-রে? একদিন অনন্যা-কেও  বললাম, কিন্তু "ও" কিছু বললো না।"
দেবদত্ত: "জানে।"
আশীষ: "রাস্তায় ওঁদের সাথে দেখা হয়ে গেছিলো তাই জিজ্ঞেস করেছিলাম। তুই চাকরি কবে পেলি?"
দেবদত্ত: "গত মাস, মানে তোর জুলাই এর পঁচিশ। একমাস সময় দিয়েছিলাম এই কোম্পানীকে, আর দশ দিন আছি এই কোম্পানীতে।"
আশীষ: "বাড়িতে আয় সন্ধ্যায়। জার্মানি  চলে যাবি! দেবাংশু ,পল্লব, আরও দু-চার জন আসে,কিছুক্ষন একসাথে কাটাই সময়।"
দেবদত্ত: "এই সময়?"
আশীষ: "হ্যা, নিজেরা-নিজেরা, একটু সাবধানে আর কি।" 
দেবদত্ত: "সে তো যাবোই। শোন আমি কিন্তু সামনের মাসের এক-তারিখেই চালসায় চলে যাবো।"
আশীষ: "পুজো-টাও তাহলে ওখানেই কাটাবি। অবশ্য এবার পুজো তো হবেনা তেমন!"
দেবদত্ত: "হ্যা আশীষ। সেপ্টেম্বর এর শুরুতেই  উঠছি তোদের বাড়ীতে।"
আশীষ: "হূম! সে সব অসুবিধে হবে না।"
দেবদত্ত: "মাসের ভাড়া কিন্তু দেবো, কাকিমা কে বলিস।"
আশীষ: "ভাবছি দেবু, আজকে আমরা কোথায় চলে আসলাম, একদিন কার বাড়ীতে কি হচ্ছে সে খবরও থাকতো, আর আজকে কে কোথায় চলে যাচ্ছে, কি করছে, আমরা কেউ জানিনা!  কত বদলে গেলো সব-কিছু, তুই বাড়ীতে আসবি তো?"
দেবদত্ত: "একটু হালকা হেসে বলে, আশীষ, চালসায় তোদের বাড়ীতে গিয়ে থাকবো, আর কাকু-কাকিমা, সবাইকে জানাবো না? চাবিটা কি তোর হাত থেকে বাইরে নেবো নাকি?"
আশীষ : "কি জানি!  তাই বললাম।"
দেবদত্ত: "শোন, কাল-পরশু তোদের বাড়ী যাচ্ছি, তখন সব কথা হবে। রাখলাম।"
দেবদত্ত ফোন-টা রেখে দিলো, বেশি কথা বলার আর ইচ্ছে ছিলো না, মানুষ যতো পারছে দূরে হয়ে যাচ্ছে, এটা প্রকৃতি হোক বা রোগ-ই হোক, মানুষকে নিজেদের থেকে দূরে হতে সাহায্য করছে মাত্র, আসলে মানুষ একসাথে আর থাকতেই পারছিলো না, তাই এসব হচ্ছে। 
বাড়ী-টা হয়ে গেলো, ভালো লাগছে।
আশীষ-দেড় চালসার বাড়ীতে আগেও গিয়ে থেকেছে দেবদত্ত। খুব সুন্দর ছোট পাহাড়ি জায়গা চালসা,
বাড়ীটাও সুন্দর জায়গায়। দেবদত্তের আর লোকজনের আশেপাশে থাকার ইচ্ছে ছিলো না। সবাই পলিটিক্স করতেই ব্যস্ত, নোংড়ামী।
ফোন-টা রাখার সময় বৌদি চা দিয়ে গিয়েছিলো। দেবদত্ত চা নিয়ে ছাদে চলে গেলো। যে দেবদত্ত একসময় বাড়ী থাকতো না, সকাল থেকে বন্ধু আর বন্ধু, সেই দেবদত্ত এখন কারও সাথে থাকেনা। কালকে পর্যন্ত অনন্যাকে একটু সময় দিতে বাধ্য হয়েছিলো আজ থেকে তারও প্রয়োজন নেই। ফোন করারও আর দরকার নেই। চাকরিও ছেড়ে দিয়েছে, আজকে রবিবার সবার সাথে কথা বলাই যায়, কিন্তু সেই চাগারটাই আর পায়না দেবদত্ত, তাই চা হাথে নিয়ে ছাদে যাওয়াটাই এখন বেশি ভালো লাগবে।
একা, রেলিং-এ ভর দিয়ে হাথে চা-দারুন।

দেবদত্ত মনে করলো,এই আশীষ এর একটা অধিকার আছে ওর আর অনন্যার মধ্যে। ঘটনাটা সেই সময় যখন মাধ্যমিক দেবে ওঁরা, আশীষই মাঝখানে পুরো ব্যাপারটা সামাল দিয়ে ওঁদের মিলিয়েছিলো, তাই আজকে যখন আশীষ জিজ্ঞেস করছিলো তখন অযথা রাগ হচ্ছিলো দেবদত্তের।
এখন মনে করে খারাপই লাগছিলো। তবে আর বাড়াবাড়ি না করাই ভালো তাই আশীষকে ফোন করলো না দেবদত্ত। বরং সব সমস্যা, ক্ষোভ-গুলোর কারণ থেকে আসতে-আসতে দূরে চলে যাচ্ছে ভেবে বেশ ভালো লাগছে, তাই সেই আনন্দেই থাকতে চাইলো।

 "তোকে কলেজ-তো বাড়ী থেকে ক্লাস নেওয়ার  নির্দেশ দিয়েছে। কোথায় বের হতে হয় তোকে?"একটু রাগ নিয়েই অনন্যার মা' অনন্যাকে বললেন।
অনন্যা: "মা', একসপ্তাহ ধরে কোথায় বের হলাম? কত কাজ আমার করা হলোনা।"
"কাজ করা হলোনা! সাতটা দিন একটু আরাম করলি। তার আগে নাওয়া নেই খাওয়া নেই মেয়ে ছুটছে, কিসের যে সমাজ কার্য?
আর এই যে আজকাল কি হয়েছে বলতো? তুই বাড়িতে আছিস বোঝাই যায়না, খাবার নিয়ে গেলে বাইরের টেবিল এই রেখে দিতে বলিস। তোর শরীর ঠিক আছে তো? কিছু তো আবার জিজ্ঞেস করাও যায়না। আজকালকার ছেলেমেয়ে কি যে এতো  ঘুচুর-মুচুর ফোনে, কে জানে?"
অনন্যা কোনো উত্তর দিলো না। বাড়ী থেকে বেরিয়ে আসলো, দিন কিভাবে শেষ হয়ে যায়! দেবদত্তের সঙ্গে শেষ কথা কতো দিন হয়ে গেলো, এটা ভাবলে হাসিও পায়, কারণ সাথে-সাথে এই ভাবনাও আসে যে আজকে মাধ্যমিক দেওয়াও  পনেরো বছর হয়ে গেছে। দিন এভাবেই চলে যায়। 
মায়ের কথা ভেবে হাসলো অনন্যা, সময় কাজ-ছাড়া কাউকে রাখেনা, যুদ্ধের সময় মৃতদেহ সরানো-টাও একটা কাজ হয়ে দাঁড়ায়। যেমন আজকে গোয়েল বিষ রোগের ওষুধ বিক্রি করছে।
অনন্যা আর কিছু ভাবার চেষ্টা না করে হাঁটার গতি বাড়ালো।

"দেবদত্ত ওই দেবদত্ত।" পেছন থেকে কেউ ডাকছে, পেছনে তাকালো দেবদত্ত।
"ওহ, সুদীপ।" 
সুদীপ,"আশীষ বললো তুই নাকি চলে যাচ্ছিস?"
দেবদত্ত একটু হেসে, যাওয়ার চেষ্টা করছি। "তোর খবর কি?"
-- "এখন তো খবর একটাই। লড়াই। তা কোথায় যাচ্ছিস?"
কোথায় যাচ্ছে দেবদত্ত সেটা যে সুদীপ জানে সেটা ভালো করেই দেবদত্ত বুঝেছে, এটাই বিরক্তিকর, খালি কথার খেলা, আর এই খেলায় সবাই মত্ত হয়ে আছে, যে যাঁকে পারছে তাকে ছোটো করছে, ঠকাচ্ছে, 
জালিয়াতি ছাড়া আর কিচ্ছু নেই, একটা লোক কারও কথা ভাবে না, দেশের কথা তো? 
কারও সাথে দেখা করতেই আর ইচ্ছে করেনা এরজন্য। সুদীপকে কোনো উত্তর দিতেও ইচ্ছে করলোনা দেবদত্তের," আমি কিছু দরকারি কারণে শিলিগুড়ি এসেছি, ভালোই হলো দেখা হলো তোর সাথে।আপাতত ভালো অবস্থা আসা পর্যন্ত চালসায় আশীষদের বাড়িতে থাকবো। 
এখন যাই বুঝলি, একটু দরকার আছে, পরে ফোন করবো।" দেবদত্ত বেশি সময় না দিয়ে মার্কেটের ভেতরে ঢুকে গিয়েছিলো।
সুদীপ  একটুক্ষণ দাঁড়িয়েছিলো, তারপর সুদীপ ও  নিজের লক্ষ্যে এগোয়।


একটা নির্মমতা সর্বত্র ছেয়ে আছে। রাস্তা-ঘাটে সর্বত্র কোনো কিছুই কোনো কিছুকে আর গ্রহণ করতে পারছেনা। সবাইকে যেনো এতদিনের করা ঔদ্ধত্বের ফল পৃথিবী তুলে দিতে চাইছে।
পৃথিবী বা প্রকৃতি যে এর জন্য দায়ী না সেটা বুঝিয়ে যাচ্ছে প্রতি নিয়তো, সন্ধ্যেবেলা ঠিক একটা আরাম নিয়ে আসে চারদিকে। মানুষ থেকে পশু-পাখি সবাই আজকেও উপল্বদ্ধি করে সন্ধেবেলার সেই আরামটাকে। প্রকৃতি যেনো শেষ করতে চায় দিন, শেষ করতে চায় সবকিছু। কিন্তু কোথায় যেনো একটা ম্যাগনেট আছে মাঝখানে, যেটা আবার টেনে নিয়ে যায় বিপরীত মেরুতে।

দেবদত্ত ভেনাস মোড়ে লাগানো চায়ের দোকানে চা আর সিগেরেটে মুখ দিছিলো আর ভাবছিলো সবচেয়ে কঠিন সময়ের মুখোমুখি হওয়ার। বাড়িতে বলা, কি করতে চলেছে দেবদত্ত। অনেকবার ট্রাই করেছে আগে বলার কিন্তু পারেনি বলতে। কোম্পানীর হয়ে জার্মানির যাওয়াটা নতুন কিছু না,  অসুবিধের হলো সময়টা সঠিক নয়,  তারপর আবার আগে একা চালসায় গিয়ে ওঠা।
মন-মেজাজ ভালো না, তাই একটু একা থাকতে চায় বলে বোঝবে ঠিক করলো দেবদত্ত। 
ঠিক করে সিগেরেটে একটা ভালো টান  দিলো। দেবদত্ত জানে এই সময় বাইরের খাবার বা অন্য কিছুও এড়ানো দরকার কিন্তু সবসময় মানতে ভালো লাগেনা। তাই চা আরও একবার নিলো, আর  আরও একটা সিগেরেট ধরিয়েছে।
বেশ কয়েকবার ফোন-টা বেজেছে। কোনোরকমে পকেট থেকে বের করলো দেবদত্ত।
সেকি! অনন্যা ফোন করেছে! একটু অবাক হলো, এখন সত্যি আসা করেনি অনন্যাকে। কয়েক সেকেন্ড দেখলো নাম-টা ফোনের ওপর।
--"বল,অনন্যা।"
দেবদত্তের মনে হলো অনন্যার কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে।
দেবদত্ত এবার একটু চেপে বললো, "হ্যা বল অনন্যা।" 
"দেবু, আমার করোনা পজেটিভ।"
-- "কি বলছিস ফালতু কথা, কোথায় তুই?"
অনন্যা একটু সময় নিয়ে খুব ধীরে বললো," আমি ফোন করলে-মা', বাবা ঘাবড়ে যাবে, তুই একটু দেখ, আমি নূটিয়া হাসপাতালে।"
হালকা হয়ে গেলো দেবদত্তের শরীর। সবকিছু খালি মনে হচ্ছে। সবকিছু যেনো শেষ হয়ে যাচ্ছে। কি হচ্ছে এটা? ''ও" কি করবে?  কিছু মাথায় আসছেনা। কেমন যেনো ঘুরছে চারপাশটা। জোর করে আশীষকে ফোন করলো কোনোরকমে। 
রিং হচ্ছে, আশীষ তুলছেনা ফোন। বারবার ফোন যাচ্ছে কিনা দেখছে দেবদত্ত।
আশীষ ফোনটা তুললো।
"হ্যা, আশীষ.....অনন্যা নুটিয়া-তে।"
--"কেনো? কি হয়েছে?"
-- "করোনা।"
--"মানে? কার?"
--"অনন্যার।"
-- কি বলছিস দেবু!। আর তুই কোথায়?"
--"ভেনাস মোড়ে।" 
--"তুই দাড়া, আমি জাস্ট আসছি।"
দেবদত্ত জানে,কিছু হবেনা অনন্যার তবু কেনো একটা ভয় হচ্ছে, এর আগে বাড়ীতে বা অনন্যার বাড়িতেও অনেক মেডিক্যাল ক্রাইসিস সামলেছে, এরকম কখনও হয়নি বরঙ মাথা ঠান্ডা রেখে ক্রাইসিস সামলানোর জন্য দেবদত্তের প্রশংসাও সবাই করে, অথচ আজকে মাথা ঠান্ডা রাখতে পারছেনা। হয়তো এই রোগটার ব্যাপারে বেশি জানেনা বলেই বা অনন্যার থেকে দূরত্বটা কি মন কখনো মানেনি?  
ভালো হয়ে যাবে সে নিয়ে চিন্তা নেই কিন্তু এতটা ফাঁকা-ফাঁকা লাগছে, যেনো শক্তি নেই।
জোর করে সাহস আর চিন্তাশক্তি কে ঠিক করছে দেবদত্ত। ফোন করলো অনন্যাকে।
অনন্যার আওয়াজ সময়-সময় কমে যাচ্ছে," হ্যা দেবু, বল''।
--"কি হচ্ছে ওখানে?"
--"চিন্তা করিসনা, বেড এ শুয়ে আছি। মা', বাবা'কে বলেছিস?"
--"আশীষ আসছে,বাড়ি যাবো, ফোন-এ বললে ভয় পাবে, গিয়ে নিয়ে আসবো।"
--"তাড়াতাড়ি করিস দেবু।"
আর বললো না অনন্যা। ফোন রাখার আগেই  আশীষ চলে এসেছিলো।
"কেমন আছে অনন্যা?" আশীষ মাথা নিচু করে জিজ্ঞেস করলো।
"বুঝতে পারছিনা। চল ওর বাড়ীতে।"
"আশীষ মাথা তুলে বললো, বাড়ী গিয়ে সময় নষ্ট করবো কেনো? ফোন করে জানাই।"
--"ঘাবড়ে যাবে, তারচেয়ে...."
দেবদত্ত কে পুরো বলতে না দিয়ে আশীষ বললো, "একদম না, তোর মাথা খারাপ হয়েছে, ওর ভাই আছে তো। তুই ওঁর বাবাকে ফোন কর, তারপর ভাইকে ফোন করে বল নূটিয়া আসতে, আর দেরি করিস না, চল।" 
আশীষকে পেয়ে দেবদত্ত অনেকটা ঠিক হয়েছে, দেবদত্ত অনন্যার ভাই প্রদীপকে ফোন করে জানিয়ে  বললো বাবাকে নিয়ে চলে আসতে আর এখনই গাড়ি নিয়ে ওঁদের বাড়ী যাচ্ছে কেউ সেটাও বলে দিলো।
এরপর অনন্যার বাবাকেও একই কথা জানালো," কাকু আমরা হাসপাতাল এই আছি" শেষ কথাটা জানাতে-জানাতে অনেকটা চলে এসেছিলো দেবদত্ত আর আশীষ। অংকুশ কে ফোন করে অনন্যার বাবাদের জন্যে গাড়ির ব্যবস্থা করে দিতে বললো দেবদত্ত।

হাসপাতাল। অনন্যা ভেতরে।  কেমন আছে আজকে সেটা দেখতে হচ্ছে দেবদত্তকে। কখনও ভাবেনি অনন্যার এমন হতে পারে। পা-চলতে চাইছে না, ভীড় ঠিক বুঝতেই পারছেনা দেবদত্ত, একটা ঘোরের মধ্যে রিসেপ্শন-এ শুনে দেবদত্ত পৌঁছে গেলো অনন্যার কাছে। অনেকে  হয়তো ভেতরে যেতে মানা করছিলো, হাত ও ধরেছিলো মনে হলো কেউ-কেউ, কিন্তু দেবদত্ত কিছু বুঝতে পারেনি।
অনন্যা বেড এ শুয়ে।
দেবদত্ত কে দেখে আসতে-আসতে বলল, "হাতে কিছু পরিসনি?"
--"আশীষ জোর করে দিচ্ছিলো।"
--"আমার মা', বাবা-ভাই?"
--"আসছে। কি ভাবে, তুই...."
--"খেয়াল করিনি কেন? সাবধানে ছিলামনা কেন?...তাই বলছিস তো।"
--"অসুবিধে বুঝিসনি?"
--"সন্দেহ হয়েছিলো।"
--"তাই দূরে ছিলিস?" 
--"চেষ্টা করলাম হোম আইসোলেশন করে। আর পারলামনা, তাই........"
--"সেদিন এলি কেনো আমার সাথে দেখা করতে?"
---"দেখা করা টা খুব জরুরী ছিলো, কারো কাছে যায়নি। তোর থেকেও দূরে থেকেছি, তোকে টেস্ট করতে হবেনা। এখান থেকে যা......."
অনন্যার গলার আওয়াজ আর বের হচ্ছিলোনা, কষ্ট করে বলছিলো।
পেছন থেকে মেডিক্যাল টিম এসে কথা শোনালো দেবদত্তকে। বের হতেই হবে আর এখন ভালো চিকিৎসা দরকার তাই বের হলো, বের হওয়ার সময় মুখ দিয়ে বেরিয়েছিলো ,"ভালো হয়ে যাবি "।
অনন্যা প্রাণ খুলে হেসেছিলো।
বাইরে আসতে-আসতে কানে একটা কথা গুম-গুম করে বাজছিলো, "অসুবিধে অনেক আগেই বুঝেছিলাম।"
"আমি কেনো বুঝলাম না? কেনো বুঝলামনা?"

"কেমন দেখলি?"
"কেমন দেখলে দেবদত্ত?"
প্রথম প্রশ্ন আশীষ করেছিলো। পরের কাঁদো-কাঁদো গলায় জিজ্ঞেস করলো অনন্যার বাবা, অশনি রায় মহাশয়।
অনন্যার বাবা কে দেখে দেবদত্ত শক্ত হয়ে উঠলো, ভেতর থেকে সমস্ত শক্তি জেগে উঠেছিলো। "কাকু,অনন্যা ঠিক আছে, চিকিৎসা ভালো হচ্ছে। ও-ঠিক হয়ে যাবে।"
কাকু-কে ভালো করে ধরে বাইরে বসার জায়গায় নিয়ে গেলো দেবদত্ত।  প্রদীপ, আশীষ ও সাথে-সাথে বেরিয়ে আসলো। অরিন্দম গাড়ী নিয়ে এসেছিলো, এই মুহূর্তে কোনো কথা বলা উচিত না তাই অরিন্দম চুপ করেই ছিলো। 
বাইরে এসে দেবদত্ত দেখলো অনন্যার মা' এগিয়ে আসছে। 
"কাকিমা, চিন্তা করবেনা,অনন্যা ভালো আছে।"
কাকিমা'র মুখে অস্ফুটে একটা কথাই দেবদত্ত শুনলো," মা'হয়ে কেন বুঝলামনা মেয়েকে? কেনো নিজেকে সবার থেকে সরিয়ে নিয়েছিলো বুঝলামনা?"

দেবদত্ত আর আশীষ, কাকু কাকিমা, ভাই-দেড় বসিয়েছে। হাসপাতালে করোনা চিকিৎসা একদম সেপারেট বিল্ডিং এ হচ্ছে, তাও হাসপাতাল কর্মীদের সঙ্গে পেশেন্টের পরিবারের কোনো যোগাযোগ রাখেনি। সহজে ডাক্তার এর সঙ্গেও কথা বলা যাবেনা। ফোনে যোগাযোগ করতে হবে। দেবদত্ত আর আশীষ মেইন এ ঢুকে একেবারে রিসেপশন পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিলো একটু হাসপাতাল কর্মীদের অবহেলার জন্যে। এই নিয়ে হাসপাতাল কর্মী, সিকিউরিটি গার্ড সবাইকে বাজে ভাবে ট্রিট করছিলো হাসপাতালের টপ ম্যানেজমেন্ট।  সে সব পরিষ্কার বুঝতে পারছিলো দেবদত্ত, আশীষ অনন্যার পরিবারের সবাই।
দেবদত্ত ,আশীষ দায়িত্ব নিয়ে অনন্যার বাবা, মা, ভাইকে অনেকটা দূরে একটি গাছের নিচে বেদিতে বসালো। ওঁরা জানে হাসপাতালে থেকে কোনো লাভ নেই  তবু অনন্যার পাশেই থেকে শান্তি খোঁজা। অনন্যার মা নিজেকে দায়ী করে কেঁদে যাচ্ছিলেন, বাবা আর ভাই চুপ করে বসে থাকলো।
অরিন্দম ওনাদের সাথেই দাঁড়ালো আর দেবদত্তকে নিয়ে আশীষ একটু আলাদা জায়গায় এসে দাঁড়ালো।

অনেকটা কোনায় এসে দাঁড়িয়েছে দুজন। আশীষ একটা সিগেরেট বেড় করলো,"কারা ভিড় করেছে জানিস ?"
দেবদত্ত একটু ভালো করে তাকালো,"কারা?"
"ওয়েলফেয়ার সোসাইটি,শিলিগুড়ি-র সব বাঘা-বাঘা, ওই যে রথীন দা, ওই চশমা পড়া লোকটি। তুই যখন ভেতরে ছিলি তখন রথীন দা'র সাথে কথা হচ্ছিলো।
অনন্যা দিন-রাত কাজ করে যাচ্ছিলো।"
দেবদত্ত,আশেপাশে কে বা কারা আছে কিচ্ছু দেখতে পায়নি। দেবদত্তের চোঁখে শুধুমাত্র চেনা কিছু মুখ লেগেছিলো। দেবদত্ত, আশীষ এর থেকে সিগেরেট নিলো, জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলো, আওয়াজ বের হলো না।
হয়তো আশীষ বুঝতে পারলো," এই সময় খাবার নেই অনেকের, অনেকের রোজগার নেই, তাছাড়া অনেক টাকা বেশি নিচ্ছে গাড়িওয়ালারা, এইসব কাজে নিজেকে ভীষণ ব্যস্ত করে ফেলেছিলো অনন্যা। একটু সময় নিয়ে আশীষ আবার বললো, "আজকে থেকে না, রথীন দা বললো, এক বছর ধরেই অনন্যা অনেক বেশি সময় দিচ্ছিলো আর অনেক ওপরের সারিতে উঠে এসেছিলো-ও ।"

হাসপাতাল চত্বরে মুখ-গুলো চেনা-অচেনার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে, চেনা মুখগুলো হারিয়ে যায় আবার নতুন মুখ ঢুকতে থাকে আর নতুন মুখ-গুলো পুরোনো হতে থাকে। এইভাবে সময় হারিয়ে যায়। উৎকণ্ঠা দাঁত চেপে একভাবে ধরে থাকে।
জোর করে নিজেদের নিশ্চিন্ত করতে বাধ্য করলো, দেবদত্ত আশীষ  আর অরিন্দম অনন্যার বাবা,মা,ভাই কে নিয়ে বেড় হলো হাসপাতাল থেকে। ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে দেবদত্ত আশীষ আর অরিন্দমের সাথে  আবার হাসপাতালে চলে আসবে ঠিক করলো। 


"সাবধানে থাকিস কিন্তু। দেবদত্তকে মা' খেতে দিতে-দিতে বার-বার মনে করালো।"
মা'র কাছে দেবদত্তই সব, সব কিছু দেবদত্তকে ঘিরেই ঘুরছে। বাড়ির সবার ভীষণ দুঃখ হচ্ছে অনন্যার জন্যে কিন্তু তার চাইতেও বেশি চিন্তা হচ্ছে দেবদত্ত ওখানে থাকবে। আশীষকে নিয়ে এই মুহূর্তে দেবদত্তের বাড়ির লোকের ততোটা চিন্তা নেই।
দেবদত্তের মাথা পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। সব বুঝতে পারছে। এটাই স্বাভাবিক, এটাই জীবন।
এর বাইরে চিন্তা করতে হলে সেই কাজ করতে হবে আগে।
অনন্যা সেটাই করছিলো। 
"পালাচ্ছ?"শেষ সাক্ষাতে অনন্যা বলেছিল দেবদত্তকে, সেদিন রাগ হয়েছিলো, যদিও প্রকাশ করেনি।
এতো রাগ, সমাজের ওপর পৃথিবীর ওপর কি দেবদত্ত করতে পারতো? "ও"- যা পছন্দ করেনি তা সরানোর চেষ্টা তো "ও" করেনি। সমাজে কান্ট্রিবিউশন কতোটা? নিজেকে খুশি করার চেষ্টা করেও খুশি করার মতো কোনো উত্তর দিতে পারেনি নিজেকে।
পালিয়ে গেলে যেখানে যাবে সেখানে সব একই পাবে যদিনা কেউ বদলে দিয়ে থাকে, আর সব কি অন্য জায়গাতেও বদলে গেছে?। আজকে কিছু হিসেব শুধু মিলছেই না  একটা কি যেনো সরেও যাচ্ছিলো মন থেকে।
সমাজ হোক সভ্যতাই হোক একবারে বদলায় না, একটু একটু করে বদলায় আর তার জন্য মহান হতে হয় না, একটু-একটু যোগদানে অনেকটা পার্থক্য তৈরী হয়।
অযথা একটা রাগ সব কিছু শেষ করে দিলো। কোথায়, কিসের ওপরে রাগটা যেনো সব কিছু থেকে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো দেবদত্তকে। একটা ক্ষোভ জন্মেছিলো নিজের চারপাশের ওপরে। দিন দিন কোয়ালিটি লেস হয়ে যাচ্ছিলো দেশটা। সব কিছুতে কোয়ালিটি লেস বিরক্ত করে তুলেছিলো দেবদত্তকে তারই ফলস্বরূপ অনন্যার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছিলো। অনন্যাও বুঝতে পারছিলো তাই কাজ করে যাচ্ছিলো। দেবদত্ত অনন্যার মতো করে দেখতেই পেলো না, "কেনো অনন্যা এটা কেনো  করতে গেলো?"
অনন্যার কথাগুলো সবসময় ঘিরে রাখছে দেবদত্তকে।

রাতে যাতে অসুবিধে না হয় সে ব্যবস্থা মা' আর বৌদি করে দিলে , কাউকে খুব বেশি কিছু না বলে বাইরে বেরিয়ে এসেছিলো দেবদত্ত।
অরিন্দম গাড়ী নিয়ে আশীষ কে প্রথমে নিয়েছিলো তারপর দেবদত্তের বাড়ি এসেছিলো।

আগে অনেকবার ওঁরা এরকম একসাথে বেরিয়েছে কিন্তু আজকে যে কারণে ওঁরা যাচ্ছে কারো মন ভালোনা, কারো মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছিলোনা। নিজের মতন করে অনন্যাকে নিয়ে ভেবে যাচ্ছিলো তিনজন।
আশীষও গোয়েল কে দেখতে পায়নি  হাসপাতাল চত্বরে। "অনন্যা চিপ মেন্টালিটির মেয়ে না দেবু, তুই ভালোবেসেছিলিস, কিন্তু চিনতে-জানতে-বুঝতে পারিসনি দেবু।" "অনন্যা শুধু সামাজিক ভাবে না, রাজনৈতিক ভাবেও জড়িত ছিলো সেটা হাসপাতাল থেকে বের হওয়ার সময় রাজনৈতিক লোকেদেড় উপস্থিতি বুঝিয়ে দিয়েছিলো।" "দেবু তোকে একটা সুন্দর পরাজয় তুলে দিলো।"
অরিন্দম গাড়ী চালাতে চালাতে একবার তাকালো আশীষের দিকে।
 
এতো কিছু গোপন রেখেছিলো অনন্যা দেবদত্তের থেকে।
ঠিক হলে অনন্যাকে জিজ্ঞেস করবে দেবদত্ত।
হাসপাতালে পৌঁছে গেলো গাড়ী। 
রাজনৈতিক লোকেদের ভীড় আর চাপা একটা গুঞ্জন। কেমন যেনো লাগছিলো দেবদত্তের।
ওঁদের দেখে একটু বয়স্ক একজন এগিয়ে এলো, পেছনে আরও দশ-বারো জন। 
আশীষ,"অনন্যা আর নেই, বলে কেঁদে ফেললেন ভদ্রলোক।"
কথাটা শুনে পিছিয়ে গাড়িতে সেটে গেলো দেবদত্ত।
অনন্যা।  নাম-টা ,ভেতরে চিৎকার করে যাচ্ছিলো।
অন্ধকার-একটা অন্ধকার ঘিরে ধরছিলো।
কেনো করলি? তুই জানতিস? কেনো?-কেনো? কেনো করলি সব বুঝে?
পৃথিবীটাকে এতো অচেনা কোনোদিন মনে হয়নি দেবদত্তের, কাউকেই চিনতে পারছিলোনা।


মানুষের আসার দিন আর যাওয়ার দিনের মধ্যে শুধু একটাই তফাৎ থাকে। ভবিষ্যৎ। যেদিন আসে কেউ সেদিন থেকে চারপাশে শুধু ভবিষতের কথা হয় আর যেদিন কেউ পৃথিবী থেকে চলে যায় শুধু অতীত এর কথাই হয়।
অনন্যাকে আর দেখেনি দেবদত্ত। শ্মশানে মুখ দেখেনি। কিন্তু যা-যা করতে হয় সব দায়িত্ব প্রায় একা করে যাচ্ছিলো।
দেবদত্ত আর অনন্যার বন্ধুরা সবাই সব সময় উপস্থিত কিন্তু দেবদত্ত সব সামলে গিয়েছিলো।,
আশীষ ও বাকি বন্ধুরা সাহায্য করে গেছে মাত্র। অরিন্দম তখনও একদম চুপ ছিলো ।
দেবদত্তের বাড়ির সবাই উপস্থিত ছিলো।
উপস্থিত কেউ কখনো বুঝতেই দেয়নি  এমন একটা রোগে অনন্যা ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিলো , এই রোগে মৃত  বাকিদের সাথে যেমন আচরণ হয় তা-তো হয়নি বরঙ সমাজ সচেতন, বা রাজনৈতিক লোকেরা সবাই মিলে অনন্যার পাশে-পাশেই ছিলো সর্বক্ষন।
দেবদত্ত অনন্যার বাড়ির সব দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছিলো। 

এর আগে অনন্যার পরিবারের সাথে এতো জুড়ে যায়নি কখনো দেবদত্ত, কিন্তু আজকে বাড়ির সব বিষয় আলোচনায় তাঁর থাকাটা ভীষণ প্রয়োজন হয়ে দাড়িয়েছিলো। 
অনন্যার ছেড়ে যাওয়া সামাজিক কাজগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিলো দেবদত্ত পুরোপুরি ভাবে। রাজনৈতিক লোকেদের সঙ্গেও ওঠা-বসা বাড়ছিলো অনন্যার কাজের প্রথম দিন থেকেই, প্রতিবাদী গলার আওয়াজ দেবদত্তের মধ্যে ছিলোই।
একজন মানুষ  কোনো চিন্তার সঙ্গে অনেক বেশি করে জুড়ে থাকলে একটা না সওয়া ক্ষোভ জন্মায়, কারণটা বেশি এক্তিয়ারেসে দেখতে পায় শুধু নোংরামী,  অনৈতিক,সুবিধেভোগীদের ভীড়। একদিন দেবদত্তকে জাপটে ধরেছিলো সেই বিষ।  আজকে আর নেগেটিভ নিয়ে ভাবতে রাজি নয়  দেবদত্ত, বরঙ আজকে সব সময় মনে হচ্ছে, কাজ আছে অনেক কাজ।

আজকে দেবদত্তর কাছে সব পরিষ্কার, আজকে দেবদত্ত শুনতে পায়  অনন্যা বলছে,"দেবু,পনেরো বছরের ওপরে আমাদের সম্পর্ক, এর চাইতে বড়ো অভ্যেস এক-জনের জীবনে আর কিছু হতে পারেনা। তাই আমার যাওয়ার সময় তোর থাকাটা জরুরি ছিলো তাই তোকে ডেকেছিলাম। "
"দেবু তুই ছিলিস তাই অন্যরা ছিলো,"।
"আমি, পালাইনি দেবু, আমাদের মনের ভেতরে আরও একটা মন থাকে, তার কাছে কিছু জানতে চাইনা আমরা, তোর থাকার কারণগুলো পৃথিবী, প্রকৃতি তোকে তুলে দিয়েছে তুই সেই কারণগুলো থেকে পালতে চাইছিস। ভালোর সন্ধানে তো যেতে সবাই চায়। আমি দোষ দিতে না দোষ নিতে বেশি পছন্দ করি।" 
শুনতে পায় দেবদত্ত অনন্যার শেষ চোঁখে কি বলেছিলো ," যার মধ্যে এতো সাহিত্য, তাঁকে আমি কোনোদিনই ছাড়তাম না, তাই যাওয়ার আগে তোর চোখ পড়ে গেলাম।"

দেবদত্ত চলে যেতে চেয়েছিলো, কিন্তু অনন্যা চলে যাবে কোনো ভাবেই মেনে নিতে পারেনি, আর দেবদত্ত শুধু দেশ ছাড়তে চেয়েছিলো, কিন্তু অনন্যা ......., 


একটা যন্ত্রের মতো সব দিক সামলে যাচ্ছিলো দেবদত্ত। আসতে আসতে অনন্যার বাড়ী যাতে জীবনের মধ্যে বেরিয়ে আসতে পারে সেই চেষ্টা করে গেছে। দেখতে দেখতে এক বছর হয়ে গেলো। ইচ্ছে করেই অনন্যার বাড়ীর সবাইকে ছোটো ছেলের দিকে চিন্তা ভাবনা নিয়ে আসছিলো দেবদত্ত। আর বন্ধুরাও অনেক ভাবে সাহায্য করে গিয়েছে দেবদত্তকে। বন্ধুরা মোটামোটি সবাই অনন্যারও বন্ধু ছিলো। অনন্যা প্রত্যেকের জীবনের সঙ্গে নিজেকে এক করে নিয়েছিলো তাই ওঁর প্রত্যেক বন্ধু নিজের মতন করে অনন্যাকে পেয়েছিলো। 

দেবদত্ত জানে  আসতে আসতে একটু একটু করে মুছে যেতে থাকবে অনন্যা আর নতুনেরা জায়গা নিতে থাকবে কিন্তু দেবদত্ত কোনোদিনও আলাদা হতে পারবেনা অনন্যার থেকে,  সে  থেকে যাবে কাজগুলোর মধ্যে যেখানে অনন্যা  নিজেকে খুঁজে পেয়েছিলো একদিন।

ভীষণ দায়িত্ব নিয়ে রাজনৈতিক, সামাজিক কাজ সম্পূন্ন করে যাচ্ছে, সব কিছুর খেয়াল রাখে,কোনো জমায়েত যাতে নতুন করে কোনো রোগ বৃদ্ধির কারণ না হয় সেদিকে ভীষণ নজর দিয়ে থাকে, বলতে গেলে জন প্রতি চোখ রাখে, কে কি করছে। কে কি ভাবছে।
সবসময় অনন্যার কথা মাথায় থাকে দেবদত্তের।
একটি সার্বিক রোগমুক্ত পৃথিবী তুলে দিতে চায়, যেখানে মানুষ বেঁচে থাকতে পারে।


 অনন্যার চলে যাওয়া দিন আর  ইচ্ছে করে মনে রাখেনি দেবদত্ত, তাঁর  কাছে এখন অনেক কাজ।
রাজনৈতিক ভাবে, অরাজনৈতিক ভাবে।
অনন্যা অনেক কাজের খসড়া তুলে দিয়ে গিয়েছিলো। অনেক স্বপ্নো দিয়ে গিয়েছিলো।
চালসায় দেবদত্ত গিয়েছিলো পরে বার কতক, কিন্তু সামাজিক কাজে। 
আশীষের চালসার বাড়ী একবার গিয়ে দেখে এসেছিলো।
জার্মানি আর যাওয়ার জন্য নয় ভালো লাগে জাতির প্রতি ওঁদের অভিমানের জন্যে।
দেবদত্ত এখন আশীষ আর অরিন্দমের সাথে মিলে প্লাস্টিক পাইপিং এর ডিস্ট্রিবিউশন এর কাজ নিয়েছে সাথে আরও একটি ব্যাবসা। ব্যবসার টেকনিক্যাল সাপোর্ট দিয়ে থাকে দেবদত্ত, তবে বাকিরা ওঁকে অনেকটা রিলিফ দেয় যাতে অনন্যার কাজগুলো দেবদত্ত করে যেতে পারে।
দেবদত্তের দাদা আর বৌদিরা ব্যাঙ্গালোরে ফিরে যাওয়ার চিন্তা ছেড়ে দিয়েছিলো। ভাইজি আর ভাইপো কে শিলিগুড়িতে স্কুলে ভর্তি করা হয়েছে। দাদা এখন বাড়ী থেকেই কাজ করবে। মা, বাবা আর দাদা বৌদি মাঝে মাঝেই অনন্যার বাড়ীতে সময় কাটিয়ে থাকে।

অনন্যা একসাথে অনেকের কাছে অনেক ভাবে বেঁচে থাকার কারণ দিয়ে গিয়েছিলো। আসে পাশের সবাই নিজের মতন করে বাঁচার উদ্দেশ্য নিয়ে নিয়েছিলো। 

 দেবদত্ত আর অনন্যা থাকে যে কাজে ওঁরা শান্তি পায়, সেই কাজের মধ্যে।।

















Post a Comment

0 Comments