কলমে : মধুপর্ণা ব্যানার্জী
দোকান থেকে ফিরে নবগোপালবাবু একটুখানি জিরিয়ে নিচ্ছিলেন, এমন সময় তারাসুন্দরীর অমায়িক গলার চেঁচামেচি শুনে আর বসে থাকতে পারলেন না। বুঝতে পারলেন দোতলায় ঠাকুরঘর থেকেই আওয়াজ আসছে। তিনি একটু গলা খাঁকারি দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন...
“আরে গিন্নি কি হয়েছে, এতো গোলমাল কিসের জন্য। বাবার এখন বিশ্রামের সময় তোমার গলা শুনে তাঁর ঘুম ভেঙে গেল যে ।”
তারাসুন্দরী কাঁচুমাচু মুখে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বললেন...
“আরে কি যে করি, রোজ এই এক কান্ড শুরু হয়েছে, প্রথম দুদিন আমি কিছু বলিনি কিন্তু এই নিয়ে পরপর তিনদিন হয়ে গেল, আমার গোপালের ভোগ কেউ চুরি করে খেয়ে নিচ্ছে।কি অনাসৃষ্টি কান্ড, ঠাকুরের ভোগ এভাবে এঁটো করলে সংসারের অকল্যাণ হবে যে।“
নবগোপাল বুঝলেন সমস্যা বেশ জটিল। তাঁদের বাড়ির গোপাল চিরকালই বড়ো আদর যত্নে থাকেন। প্রতিদিন দুপুরে তাঁর জন্য কোনো বিশেষ মিষ্টির ভোগ দেওয়া হয়। বাড়ির গিন্নি নিজের হাতে সেই ভোগ রান্না করে নিবেদন করেন। তারপর ঠাকুর ঘরের দরজা ভেজিয়ে দিয়ে ঠাকুরকে ভোগ গ্রহণ করতে দেওয়া হয়। প্রায় আধঘণ্টা পর সেই ভোগের প্রসাদ বাড়ির সবাইকে দেওয়া হয়। শুধু বাবার সুগার বেড়েছে বলে ওনাকে মাসখানেক হলো প্রসাদ দেওয়া হয় না। দুধপুলি, পায়েস, পাটিসাপটা,মালপোয়া,নাড়ু ,মোহনভোগ একেক দিন একেক রকম রান্না,গোপালের দুপুরের খাবার।
নবগোপাল স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন...
“আমার মনে হয় তোমার গোপাল নিজেই খেয়ে নিচ্ছে, এতো সুন্দর খাবারের লোভ সামলানো মুস্কিল আর গোপাল তো এইসব ব্যাপারে বিখ্যাত।“
তারাসুন্দরী এতো সহজে ভোলবার পাত্রী নন, তিনি প্রথম দুদিন ঈশ্বরের কৃপা ভেবে চুপচাপ ছিলেন, কিন্তু রোজ রোজ এই কৃপাদৃষ্টি দেখে সন্দেহ হয়, তারপর আজকে দুধপুলি খেয়ে কয়েকটি জায়গায় দুধের ফোঁটা ফেলেছে।ঠাকুরঘরের বাইরেও পড়েছে তার ওপর পায়ের আঙুলের ছাপ পড়েছে। অতএব এ কোনো চোরের কীর্তি।
নবগোপাল মনে মনে ভাবেন তাঁদের ছেলের তো মিষ্টি খাওয়ায় তেমন রূচি নেই, তবে ছেলের একখান ফচকে বন্ধু আছে সেটা তো বাড়িতে এলেই এক প্লেট মিষ্টি সাবাড় করে দেয়। সেই ব্যাটাই চোর নয় তো...
স্ত্রীকে বুঝিয়ে বলেন তিনি খুব শীঘ্রই সমস্যার সমাধান করবেন। তারপর ছেলে নবকুমার কে ডেকে সবকিছু খুলে বলেন, নবকুমার নিজের বন্ধুর সম্বন্ধে এইসব অভিযোগ অস্বীকার করে। তবে সে বলে এই ব্যাপারটা নিজেই খতিয়ে দেখবে।
পরদিন দুপুরে নবকুমার বাবাকে ডেকে বলে...
“বাবা ,চোর আমাদের বাড়ির লোক, কি আর বলবো তোমায়, আমি ভাবছিলাম সিসিটিভি ক্যামেরা লাগিয়ে দেবো। তবে তার আগে নিজে একবার চেষ্টা করে দেখতে পারি। আমি ছাদের সিঁড়িতে উঠে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে ছিলাম, মা ঠাকুরঘরে ভোগ দিয়ে দরজা ভেজিয়ে দিয়ে নীচে নেমে যাবার দশ মিনিট পরে দেখি , দাদু পা টিপে টিপে ঠাকুর ঘরে ঢুকে এই মহান কার্য করছেন। আমি প্রমাণ স্বরূপ মোবাইলে কিছু ছবি তুললাম। কিন্তু খুব খারাপ লাগছে , বাবা কি করা উচিত বলোতো, দাদুর সুগার বেড়েছে বলে মিষ্টি দেওয়া বন্ধ করেছে মা। এখন বুড়ো মানুষের মিষ্টি খাওয়ায় ঝোঁকে এই কান্ড।“
নবগোপাল বুঝতে পারলেন খুব জটিল পরিস্থিতি, স্ত্রী জানতে পারলে হয়তো কিছু বলবে না। কিন্তু বাবা যদি বুঝতে পারেন সবাই জানে তাহলে হয়তো খুব কষ্ট পাবেন।। তিনি ছেলের সাথে পরামর্শ করে স্ত্রীকে বুঝিয়ে বলেন, বাবার অনেক বয়স হয়েছে এখন আর খাওয়ার ব্যাপারে বেশি কড়াকড়ির দরকার নেই। মানুষটির জীবনের কদিন বা বাকি আছে,তাই রোজকার ঠাকুরের ভোগ ওনাকেও আবার দেওয়া হোক।
তারাসুন্দরী চোখের জল মুছে বৃদ্ধ শ্বশুরের জন্য দুধপুলি পায়েস নিয়ে যান।সব চুরির শাস্তি দেওয়া যায় না।
#সমাপ্ত
0 Comments